এরপর বাবা বিরক্ত হয়ে আমাকে টেলিফোন দিয়ে দিয়েছেন। বাবা কথায় কখনও আমার সঙ্গে পারেন না। যখন পারেন না, তখন হামকি-ধামকি করেন।
আমার মোবাইল টেলিফোনের নাম্বার ০১৭৮১১৯২২৩০। আমার উপন্যাস যদি ছাপা হয়, কেউ যদি কিনে পড়েন, তাহলে আমাকে এই নাম্বারে টেলিফোন করে জানাবেন। রাত বারোটার পরে করবেন, তখন কলচার্জ কম। আমি অনেক রাত জাগি।
এখন বলি আমরা কোথায় থাকি। কলাবাগানে। বিশ বছর আগে বাবা তার এক বন্ধুর কাছ থেকে তিন কাঠা জায়গা কিনেছিলেন। সেই তিন কাঠায় বাবা দোতলা বাড়ি বানিয়েছেন। আমরা দোতলায় থাকি। বাবার ব্যবসার লোকজন ট্রাক ড্রাইভার, ট্যাক্সি ড্রাইভার, দোকানদার, নাপিত—এরা সবাই একতলায় থাকে।
একতলার দুটা কামর বাবা ভাড়া দিয়েছেন। সেখানে জামান নামে এক ভদ্রলোক তার স্ত্রী এবং শালাকে নিয়ে থাকেন। জামান সাহেব কিছুদিন পরপরই তার শালাকে মারধর করেন। শালাটার নাম সনজু। সে কলেজে পড়ে। সেকেন্ড ইয়ার। হাবা টাইপের। দুলাভাইয়ের মার খেয়ে সে হাউ হাউ করে দেতিলার সিঁড়িতে বসে কাঁদে। ছেলেটা দেখতে সুন্দর আছে, তবে অতিরিক্ত রোগা। সে যদি আমাদের সঙ্গে পড়ত তাহলে আমি তার নাম দিতাম সুতা কৃমি।
এখন আমি আপনাদের সুতা কৃমির একটা মজার গল্প বলব। উপন্যাসের নিয়মে এই গল্প আরো পরে বসা উচিত কিন্তু পরে ভুলে যাব বলে এখনি বলছি। উপন্যাসের নিয়মে চরিত্রদের চেহারা এবং আচার-ব্যবহার কিছুটা বর্ণনা করা দরকার, যাতে পাঠক চরিত্র সম্পর্কে ধারণা করতে পারে এবং কল্পনায় সে একজনকে দাড়া করাতে পারে। আমি বাবার চেহারা বর্ণনা করতে ভুলে গেছি। সুতা কৃমি সম্পর্কে শুধু বলেছি দেখতে সুন্দর। এখন দুজনের চেহারার বর্ণনা দেব। তারপর সুতা কৃমির গল্পটা বলব।
বাবা
জনাব আব্দুল খালেদ খান
বয়স চল্লিশ মিডিয়াম হাইট। মোটাসোটা। ভুড়ি আছে। মাথায় টাক। গোঁফ আছে। মোটা গোফ। গোঁফ খানিকটা পাকা। কানে লম্বা লম্বা লোম আছে। এইগুলি তিনি কখনও কাটান না। কানের লোম না-কি লক্ষ্মী, কাটতে নেই। মুখ গোলাকার। গায়ের রঙ ফর্সা। চোখে চশমা পরেন। প্রচুর পান খান বলে দাঁতে কালো কালো দাগ আছে। তার কানে যেমন লম্বা লম্বা লোম আছে, নাকেও আছে। চুল কাটার সময় নাপিত নাকের গর্তে কেঁচি ঢুকিয়ে নাকের চুল কেটে দেয়। নাপিত এই কাজটা আমাদের বাসায় এসে করে বলে আমি দেখেছি। কুৎসিত দৃশ্য।
ভুল ইংরেজি অবলীলায় বলা বাবার স্বভাব। ট্রাক ব্যবসায় তিনি Loss খেয়েছেন এর ইংরেজি তিনি করলেন Big lost in truck business.
রাগারাজি, হৈ চৈ করা তার স্বভাব। তার ড্রাইভারদের তিনি বস্তি টাইপ গালাগালি করেন আবার কিছুক্ষণ পরেই, বাবা রে! কেন এরকম করিস বলে পিঠে হাত দেন।
সুতা কৃমি
সনজু
বয়স ১৮-১৯ কিংবা ষোল-সতেরো। রোগা। লম্বায় খুব সম্ভব পাঁচ ফিট সাত ইঞ্চি। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। চেহারা বালক বালক। মুখ লম্বাটে। চোখ মেয়েদের মতো। অর্থাৎ চোখের পাপড়ি বড় বড়। নাক সামান্য চাপা। ডান দিকের কপালে লাল তিল আছে। মাথার চুল কোঁকরানো, প্রায় নিগ্রো টাইপ। ঠোঁটও নিগ্রোদের মতো মোটা। তবে দেখতে খারাপ লাগে না।
এখন সুতা কৃমির ঘটনাটা বলি। সেদিন ছিল বুধবার। বুধবার সকালে আমার কোনো ক্লাস নেই। প্রথম ক্লাস এগারোটায়। ক্লাস নেবেন রবীন্দ্রবিশারদ ড. সিদ্দিক। রবীন্দ্রবিশারদরা সাধারণত নজরুলবিদ্বেষী হয়। তিনি নজরুলবিদ্বেষী। তার ধারণা কবি নজরুল একজন মহান পদ্যকার ছাড়া কিছুই না।
সিদ্দিক স্যার কখনও রোল কল করেন না, সবাইকে পার্সেন্টেজ দিয়ে দেন। কাজেই আমি ঠিক করলাম কলেজে যাব দুপুরের পর। টিভি দেখার জন্যে টিভি ছেড়েছি (বাবা বাসায় নেই তো, টিভি ছাড়া যায়)। জিটিভিতে শাহরুখ খানের কি একটা ছবি দেখাচ্ছে। শাহরুখ খানের অভিনয় আমার ভালো লাগে না। তার চেহারা ফাজিলের মতো, অভিনয়ও ফাজিলের মতো। তারপরেও দেখছি। হঠাৎ সুতা কৃমির বোন হাউমাউ করে দরজা খুলে ঘরে ঢুকেই বলল, তরু আমার ভাইটাকে বাঁচাও, ওকে মেরে ফেলছে। ওর দুলাভাই ওকে মেরে ফেলছে। আমি ছুটে গেলাম।
গিয়ে দেখি রক্তারক্তি কাণ্ড। বেচারা লুঙ্গি পরেছিল। লুঙ্গি খুলে গেছে। সে মেঝেতে নেংটা হয়ে পড়ে আছে। ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে। হাত কেটে রক্ত পড়ছে। সুতা কৃমির বোন নীলা ভাবী লুঙ্গি দিয়ে ভাইকে ঢাকল। আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললাম, কী করছেন আপনি! এখন এ যদি মারা যায় আপনার তো ফাসি হয়ে যাবে। আমি সাক্ষী দেব।
ভদ্রলোক বললেন, তরু তুমি জানো না এ কত বড় চোর। আমার বিশ হাজার টাকা চুরি করেছে। নিজের হাতে ব্রাউন পেপারে মুড়ে ড্রয়ারে রেখেছি। আমরা তিন জন ছাড়া ঘরে আর কেউ আসে না …
আমি বললাম, কথাবার্তা পরে শুনব। এখন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
আমার কথা শেষ হবার আগেই সুতা কৃমি রক্ত-বমি করা শুরু করল। এই দেখে সম্ভবত তার দুলাভাইয়ের টনক নড়ল। স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে সুতা কৃমিকে নিয়ে রওনা হলো হাসপাতালের দিকে।
দুপুরে ভাত খাচ্ছি, নীলা ভাবী এসে জানাল ডাক্তাররা তার ভাইকে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। আর টাকাটা চুরি হয় নাই। পাওয়া গেছে।
আমি বললাম, কোথায় পাওয়া গেছে?
নীলা ভাবী চোখ মুছতে মুছতে বলল, খাটের নিচে। ড্রয়ার থেকে নিচে পড়েছে, পায়ের ধাক্কা লেগে চলে গেছে খাটের নিচে।