আনিস শুকনো মুখে বলল, হুঁ।
তরু বলল গল্পের শেষটা বলব? মেয়েটা চায়ের সঙ্গে সায়ানাইড মিশিয়ে বুড়োটাকে খেতে দেয়।
সায়ানাইড?
হ্যাঁ সায়ানাইড। পটাশিয়াম সায়ানাইড। কেমিক্যাল ফর্মুলা হচ্ছে KCN. জানেন আমার কাছে এক কৌটা পটাশিয়াম সায়ানাইড আছে। দশ গ্রামের মতো। আমার এক বান্ধবী কেমিস্ট্রি পড়ে। তার কাছ থেকে নিয়েছি। নিজে কখনো খাব না। অন্যদের খাওয়াব।
আনিস বলল, এখন আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে তুমি বিয়েটা ভেঙ্গে দেবার চেষ্টা করছ। সরাসরি বলো তো তুমি কি চাও বিয়েটা হোক?
না।
কারণ কি ঐ পঙ্গু বুড়ো? সিন্দাবাদের ভূত?
হুঁ। চা দিতে বলুন তো। দুপুরে খাবার পর আমি সবসময় চা খাই।
আনিস গম্ভীর মুখে চায়ের অর্ডার দিল।
তরু বলল, আপনি তো কিছুই খান নি।
আনিস বলল, আমার খাবার নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। চা শেষ করো। চলো তোমাকে বাসায় নামিয়ে দেই। তরু আরেকটা কথা শোনো। বিয়ে কিন্তু আমি ভাঙব না। বিয়ে ভাঙতে হলে তোমাদের ভাঙতে হবে।
তরু বলল, আমি একজন বুড়ো মানুষের প্রেমে খাবি খাচ্ছি এটা শুনেও বিয়ে ভাঙবেন না?
আনিস বলল, না। কারণ তুমি বুড়োর প্রেমে খাবি খাওয়ার মেয়ে না। আমার সঙ্গে জটিল খেলা শুরু করেছ। আমি যথেষ্ট বেকুব বলে খেলাটা ধরতে পারছি না। ভালো কথা, তোমার ঐ ছেলে এসেছিল আমার কাছে।
কোন ছেলে?
নাম সনজু। দুটা ছবি নিয়ে উপস্থিত! একটাতে তুমি বুড়োটার কোলে বসে আছ। আরেকটাতে বুড়ো তোমার গলা জড়িয়ে ধরে আছে। ফটোশপের কাজ, খুবই খারাপ হয়েছে। দেখেই বুঝা যায় নকল ছবি।
ছবি দেখার পর আপনি কি করলেন?
আমি ঐ ছেলের গলা চেপে ধরলাম। এমন চাপ দিলাম যে তার চোখ কোঠর থেকে বের হবার জোগাড়। সে সঙ্গে সঙ্গে সব স্বীকার করল। কোন ফটোগ্রাফের দোকান থেকে কাজটা করেছে তার নাম বলে চোখের পানি, নাকের পানিতে একাকার।
আপনি তো মহাগুণ্ডা।
মহাগুণ্ডা না। ছোটখাটো গুণ্ডা। চল উঠি—
তরু বলল, আপনার তাড়া থাকলে আপনি চলে যান। আমি আরো কিছুক্ষণ বসব। পরপর চার কাপ চা খাব। এদের চা-টা খুব ভালো হয়েছে। আপনি এই ফাঁকে আমার গল্পটা পড়ে ফেলুন।
তরু চা খাচ্ছে। বিরক্ত মুখে আনিস গল্প পড়তে শুরু করেছে। গল্পের নাম-সিন্দাবাদের দৈত্য না। নাম—-মুন্সিগঞ্জের হেমন্ত। আঠারো-উনিশ বছরের একটা ছেলে যে হেমন্তের মতো গান গায়। কনট্রাক্টে মানুষের পেটে ছুরি বসিয়ে দেয়।
গল্প শেষ করে আনিস বলল, খুবই সুন্দর গল্প। বিশ্বাসই হচ্ছে না তোমার লেখা। গল্পটা দিয়ে নাটক বানালে অসাধারণ নাটক হবে। আমি করব। মুন্সিগঞ্জের হেমন্তের রোল। তরু তুমি নাটক লিখতে পারো?
না। আমার চা খাওয়া শেষ। আমি এখন উঠব।
আনিস আগ্রহ নিয়ে বলল, কিছুক্ষণ বসে গল্প করি।
তরু বলল, একজন লেখকের সঙ্গে আমার এ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। উনি একটা হোটেলে আছেন। হাতে-কলমে আমাকে গল্প লেখা শেখাবেন। এই কাণ্ড যে তিনি করবেন তা লেখকের স্ত্রী জানেন না। তবে তাকে খবর দেয়া হয়েছে। তিনি যথাসময়ে উপস্থিত হবেন। আমার ধারণা তিনি লেখককে কানে ধরে নিয়ে যাবেন। অসাধারণ একটা দৃশ্য। আপনি দেখতে চাইলে হোটেল করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন।
কি বলছ তুমি?
আপনার মোবাইল টেলিফোনে ক্যামেরা আছে না। ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলতে পারেন।
তোমার কথা আমার একবিন্দু বিশ্বাস হচ্ছে না।
তরু ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।
লেখকের নাম শাহেদ খান। বেল টেপার পর তিনি দরজা খুলে দিলেন। তরু ঢোকা মাত্র দরজা বন্ধ করে দিলেন। তার নিশ্বাস কিছুটা ভারী। কপালে ঘাম।
তরু! কিছু খাবে? চা দিতে বলব। চা খাবে?
না।
না চা খেয়ে এসেছি।
হাতে সময় নিয়ে এসেছ তো। সাহিত্যের জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা অনেক সময় লাগে।
আপনি যতক্ষণ থাকতে বলবেন থাকব।
গুড। ভেরি গুড।
আমি একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস লেখা শুরু করেছি। খাতাটা নিয়ে এসেছি। পড়ে শুনাব?
অবশ্যই পড়ে শুনাবে। তবে তরু শোনো ডিটেকটিভ উপন্যাস কিন্তু সাহিত্য না। ডিটেকটিভ উপন্যাস হচ্ছে Craft. পৃথিবীর কোনো মহান লেখক ডিটেকটিভ উপন্যাস লেখেন নি।
এডগার এলেন পো তো লিখেছেন। তিনি বড় লেখক না।
উনি বড় লেখক। তবে বিপর্যস্ত লেখক। মেয়েদের সঙ্গ পছন্দ করতেন।
আপনিও তো পছন্দ করেন।
নারী হচ্ছে চালিকা শক্তি। প্রাচীন মানুষ যখন গুহায় ছবি আঁকত তখন আলো ধরে রূপবতী নগ্ন পরীরা দাঁড়িয়ে থাকত।
নগ্ননারী দাঁড়িয়ে থাকত জানলেন কিভাবে?
অনুমান করছি। একজন লেখকের অনুমান সত্যের খুব কাছে থাকে। বাহ্ তোমার হাতের আঙ্গুল তো খুব সুন্দর। সাহিত্যের ভাষায় এই আঙ্গুলকে বলে চম্পক আঙ্গুলি। দেখি তোমার হাতটা।
|||||||||| তরু হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, স্যার আমি আপনার এখানে আসার আগে ম্যাডামকে টেলিফোন করে অনুমতি নিয়েছি। ম্যাডামও মনে হয় আসবেন।
শাহেদ খান হাত ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তার মুখ হঠাৎ ছাই বর্ণ হয়ে গেল। কলিংবেল বাজছে। ঘন ঘন বাজছে। কেউ মনে হয় এসেছে। তরু বলল, স্যার! ম্যাডাম মনে হয় এসেছেন। দরজা কি খুলব?
ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে
রাত তিনটা।
ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। তরুদের বাসার সামনে আধমরা কাঁঠাল গাছের ডাল মড়াৎ করে ভাঙল। ভাঙা ভাল পড়ল ড্রাইভার, দারোয়ানদের একতলা টিনের চালে। তাদের হৈচৈ এবং বজ্রপাতের শব্দে খালেক জেগে উঠলেন। ইলেকট্রিসিটি নেই, চারদিক ঘন অন্ধকার। শুধু তরুর ঘরে মোমবাতি জ্বলছে। খালেক মেয়ের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিলেন। ব্যাকুল গলায় বললেন, তরু কি হয়েছে রে মা? টেনশনের কারণে তিনি ভুলে গেলেন যে মেয়েকে ইদানীং তিনি পোশাকি নামে শামসুন নাহার ডাকছেন।