একটা বোকামি করেছ এটাই যথেষ্ট। দুটো বোকামি করবে না। সিগারেট ফেরত দেয়া মানে উনাকে অপমান করা! Do you understand?
তরু বলল, Yes sir.
এমন ভঙ্গিতে বলল যে, খালেক সাহেবের কাঠিন্য পুরাপুরি চলে গেল। হেসে ফেলতে যাচ্ছিলেন, অনেক কষ্টে হাসি থামালেন।
তরু বলল, বাবা তুমি কি আমাকে আরো বকবে?
খালেক সাহেব বললেন, কলাম কখন? সামান্য ওয়ার্নিং। আমাকে এক কাপ চা খাওয়া। চিনি দিবি না। লিকার হালকা।
তরু বলল, Tea is coming sir.
এইবার খালেক সাহেব সত্যি সত্যি হেসে ফেললেন। তবে তিনি খুশি যে, তার মেয়ে এই হাসি দেখে নি। আগেই ঘর থেকে বের হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েদের সামনে গাম্ভীর্য রাখাটা অত্যন্ত জরুরি। আজকালকার বাবাদের কাণ্ড দেখলে তার শরীর চিড়বিড় করে। ছেলেমেয়েরা বাবার গায়ে হাত রেখে কথা বলে। যেন বাবা তাদের ইয়ার-বন্ধু। অতিরিক্ত টেলিভিশন দেখার কুফল ছাড়া আর কিছু না। টেলিভিশন পুরোপুরি বন্ধ করে রেডিওর জগতে চলে যেতে পারলে ভালো হতো। রেডিওর যুগে সত্যতা জ্ঞান ছিল। মান্যগন্য ছিল।
এই নাও বাবা চা।
খালেক সাহেব অবাক হয়ে বললেন, এত তাড়াতাড়ি চা কীভাবে বানালি?
তরু বলল, কেটলিতে ফুটন্ত পানি ছিল, আমি একটা টি-ব্যাগ ফেলে নিয়ে এসেছি। তুমি তো চায়ে চিনি-দুধ কিছুই খাও না।
খালেক সাহেব চায়ের চাপ হাতে নিলেন। মেয়েটার উপর থেকে সব রাগ চলে গেছে। এখন উল্টো নিজের কঠিন কথাবার্তার জন্য মনটা খারাপ লাগছে। বেচারির তো দোষ নেই। লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খাবার ট্রেনিং এই মেয়েকে দেয়া হয় নি।
বাবা এই নাও সিগারেট। প্লীজ একটা খাও।
তরু তার রঙিন সিগারেটের প্যাকেট খুলে বাবার দিকে ধরে আছে। খালেক সাহেব অবাক হয়ে বললেন, সিগারেট খাব?
মেয়েদের সিগারেট। একটা খেয়ে আমাকে বলে খেতে কেমন। প্লিজ বাবা।
খালেক সাহেব সিগারেট নিলেন। তরু লাইটার জ্বালিয়ে ধরিয়ে দিল। চোখ বড় বড় করে বলল, বাবা খেতে কেমন?
খারাপ না। তুই বলেছিলি তামাক নেই। তামাক আছে।
আমি বলি নি বাবা। ওসমান চাচা বলেছেন। আমি উনাকে ধরব।
উনাকে ধরার কিছুই নেই। উনি তো আর খেয়ে দেখেন নি। অনুমানে বলেছেন। তামাক আছে তবে পরিমাণে সামান্য। না থাকার মতই। very small quantity.
খেতে ভালো লাগছে বাবা?
খালেক সাহেব দুরাজ গলায় বললেন, তোর খুব ইচ্ছা করলে একটা খেয়ে দেখ।
সত্যি খেয়ে দেখব? পরে আমাকে প্রবে না তো বাবা?
আমার সামনে ধরাবি না।
ওসমান চাচার সামনে ধরাই। উনার জিনিস উনার সামনে খেলে উনি খুশিই হবেন।
খালেক সাহেব জবাব দিতে পারলেন না। মেয়েটা মাঝে মাঝে এমন বিপদে ফেলে।
ওসমান সাহেব তরুদের বাড়ির ছাদে তিনটা ঘর নিয়ে থাকেন। তিনি তরুকে ডাকেন মিস্ট্রি। এই নামকরণ তরুর স্বভাব লক্ষ করে না। তরু অর্থ গাছ, ইংরেজিতে ট্রি। মিস তরু থেকে মিস ট্রি। সেটা সংক্ষেপ করে মিস্ত্রি। তরু এই নামের বদলা নেবার চেষ্টা করেছে, ওসমান সাহেবকে ছাচা ডেকেছে। ছাদের চাচা থেকে ছাচা। তরু কিছুদিন এই নামে ডেকে হাল ছেড়ে এখন চাচা ডাকছে।
ওসমান সাহেব বাস করেন হুইল চেয়ারে। তিনি জীবনযাপনের জন্য ছাদটাকে হুইল চেয়ার উপযুক্ত করে নিয়েছেন। বিছানা থেকে হুইল চেয়ারে নিজে-নিজে নামতে পারেন। ছাদে আসতে পারেন। কারোর সাহায্যে লাগে না। ছাদের তিনটি ঘরের একটায় তাঁর শোবার ঘর, একটা পড়াশোনা ঘর অন্যটা রান্নাঘর। হুইল চেয়ারে বসে তিনি চা বা কফি বানাতে পারেন। পাউরুটি টোস্ট করতে পারেন। ডিম সিদ্ধ করতে পারেন। সকালের নাশতা তিনি নিজের হাতে তৈরি করেন। একটা কলা, মাখন মাখা এক পিস রুটি এবং ডিম সিদ্ধ। সারা দিন এর বাইরে কিছুই খান না। রাতে টিফিন কেরিয়ারে করে হোটেল থেকে তার জন্যে খাবার আসে। যে ছেলেটি খাবার আনে তার নাম রফিক। বয়স বারো-তেরো। অতি কর্মঠ ছেলে। সে দেড় ঘণ্টার মতো থাকে। এর মধ্যেই ঘর পরিষ্কার করে, কাপড় ধুয়ে দেয় এবং কিছুক্ষণ পড়াশোনাও করে।
রফিকের জন্যে বাংলা বর্ণমালার বই এবং ইংরেজি ABCD-র বই কেনা আছে। পড়াশোনা সে যথেষ্ট আগ্রহ করেই চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলা যুক্তাক্ষর নিয়ে তার সামান্য সমস্যা হচ্ছে। যুক্তাক্ষর ছাড়া বাংলা সে ভালোই পড়তে পারে। বাংলার চেয়ে ইংরেজি শেখার দিকে তার ঝোঁক বেশি। প্রতিদিন দুটি করে ইংরেজি শব্দে তার শেখার কথা। রফিক তা শিখছে এবং মনে রাখছে। Night, star, sound-এর মতো শব্দগুলি এবং তার অর্থ সে জানে।
ওসমানের বয়স পঞ্চশি। কিন্তু তাকে সে রকম বয়স্ক মনে হয় না। মাথা ভর্তি চুল। চুলে পাক ধরে নি। গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। নিজেকে ব্যস্ত রাখার নানা কৌশল তিনি বের করে রেখেছেন। আকাশের তারা দেখা, বই পড়া, সিনেমা দেখা, গান শুনা। ইদানীং ছবি আঁকা শেখার জন্যে বইপত্র কেনা শুরু করেছেন। চারুকলার মনিকা নামের ফোর্থ ইয়ারের এক ছাত্রী প্রতি পনেরো দিনে একবার এসে তাঁকে ছবি আঁকা শেখায়। ওসমান সাহেব তাকে মাসে এক হাজার টাকা দেন।
ভদ্রলোক বিবাহিত স্ত্রী সুলতানা আলাদা বাস করেন। তিনি হঠাৎ হঠাৎ স্বামীকে দেখতে আসেন। তাদের একটা ছেলে আছে। ছেলের নাম আবীর। বয়স আট। আবীর তার মার সঙ্গে আসে। তার প্রধান আনন্দ পেছন থেকে বাবার হুইল চেয়ার ঠেলা। চলে যাবার সময় সে খুব কান্নাকাটি করে। কিছুতেই যাবে না। ওসমান সাহেব ক্ষীণ গলায় বলেন, থাকুক না একদিন। তখন সুলতানা এমন ভঙ্গিতে তাকান যেন এমন অদ্ভুত কথা তিনি তার জীবনে শুনেন নি। প্রতিবারই আবীরকে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে যেতে হয়।