জয়নাল লোকটির দিকে তাকিয়ে সহজ স্বরে বলল, ভাইজান কি…
লোকটা প্রথম একটু চমকে উঠল, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, বাতের অষুধ।
নিজেই বানান?
হুঁ। স্বপ্নে পাওয়া অধ। বত্রিশ পদের গাছের শিকড় লাগে। সব গাছও এই দেশে নাই। আসাম থেকে আনাতে হয়। বড়ই যন্ত্ৰণা।
জয়নাল মনে-মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। এই ছেলে নিতান্তই আনাড়ি। ক্যানভাসিং-এ নতুন নেমেছে। সুবিধা করতে পারবে না। ক্যানভাসিংয়ে বুদ্ধি লাগে। এই ছেলে বোকা কিসিমের। জয়নাল গলায় কৌতূহলের ভঙ্গি করে বলল, স্বপ্নটা কে দেখল?
আমার পিতাজী দেখেছেন।
সব মানুষ স্বপ্নে কেবল বাতের অষুধ পায়, বিষয়টা কি কন দেখি? এই লাইনে পাঁচজন স্বপ্নে পাওয়া বাতের অষুধ বেচে। আপনেরে নিয়া হইল ছয়।
আমি এই লাইনের না। আমি ময়মনসিংহ-জামালপুর লাইনের।
স্বপে এর চেয়ে ভালো কোনো অষুধ পান না?
আলো অষুধ মানে?
এই ধরেন ক্ষিধা নষ্ট হওনের অধ। তা হইলে গরিবের উপকার হইত।
লোকটি বিরক্ত চোখে তাকাচ্ছে।
জয়নাল বলল, আপনের পিতাজী যদি জীবিত থাকে তা হইলে তারে বলেন স্বপ্নে ক্ষিধার বড়ি জোগাড় করতে। খুব চলব। এক বড়িতে লাখপতি।
মশকরা করতেছেন?
না, মশকরা করব ক্যান? আপনে তো আমার দুলা ভাই না। নেন সিগারেট নেন। চা খাইবেন? খান আরেক কাপ। আমি দাম দিব। টেকা পয়সা হইল হাতের ময়লা। পরিমল দা ইনারে এক কাপ চা দেও, খরচ আমার।
হঠাৎ জয়নালের মন খারাপ হয়ে গেল। বাচ্চা দুটোর জন্যে খারাপ লাগছে। তবে এতক্ষণে তারা ময়মনসিংহ পৌঁছে গেছে। একটা কিছু ব্যবস্থা তারা নিশ্চয়ই করেছে। তবে সারা পথ ঐ লোক বোধ হয় তার বৌকে বকাঝকা করেছে। বৌটা চোখের পানি ফেলেছে। আহা বেচারি! আহা!
কুলি সর্দার হাশেম লম্বা-লম্বা পা ফেলে আসছে।
জয়নালের বুকটা ছাৎ করে উঠল। কিছু জানে না তো? ইস্টিশনের অনেক গোপন নিয়ম-কানুন আছে। মালামাল পাচার হলে প্রথম জানাতে হবে হাশেমকে। বিক্রির ব্যবস্থা হাশেমই করবে। দামের অর্ধেক হাশেমের বাকি অর্ধেক যে কাজটা করবে তার। তবে সোনাদানার বেলায় অন্য হিসাব।
জয়নাল বলল, হাশেম ভাই চা খাইয়া যান, খরচ আমার।
হাশেম আমল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জয়নালকে এক পলক দেখেই এগিয়ে গেল। কোনো একটা বিষয় নিয়ে তাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে। তার ব্যাপারে কিছু জেনে ফেলে নি তো? জানলে বিপদ আছে। মহা বিপদ।
চায়ের দোকান থেকে বের হয়ে
চায়ের দোকান থেকে বের হয়েই জয়নাল হুট করে এক হালি কমলা কিনে ফেলল। দশ টাকা করে হালি, দরদাম করলে আটে দিত। দরদান করতে ইচ্ছা করল না। কী। দরকার সামান্য দুটা টাকার জন্যে খেচামেচি করা। গরিব মানুষ না হয় দুটা টাকা বেশি পেল। মাঝে-মাঝে ফল-ফলান্তি খাওয়া দরকার। এতে শরীরে বল হয়। দুই হাতে চারটা কমলা দেখতেও ভালো লাগছে। এক্ষুনি খেয়ে ফেলতে হবে এমন তো কোনো কথা না। থাকুক কিছুক্ষণ হাতে। জয়নাল মালবাবুর ঘরের দিকে এগোল। মালবাবুকে বদলি করে দেবে এরকম গুজব শোনা যাচ্ছে। এটা একবার জিজ্ঞেস করা দরকার। বড় ভালো লোক। হাতির দিলের মতো বড় দিল। মালবাবুর ছেলেপুলে থাকলে কিছু কমলা কিনে দিয়ে আসত। বেচারার ছেলেপুলে নেই। ছেলেপুলে হওয়ানোটা কোনো ব্যাপার না। পীর সাহেবের লাল সুতা কোমরে বাঁধলেই হয়। তবে বিশ্বাস থাকতে হবে। মালবাবুর পীর ফকিরে বিশ্বাস নাই। জয়নাল একবার পীর সাহেবের কথা বলতে গিয়ে ধমক খেয়েছে। পীর সাহেবকে নিয়েও মুখ খারাপ করেছেন। খুবই অনুচিত কাজ হয়েছে। পীর ফকির নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করার ফল শুভ হয় না। এই যে বদলির কথা শোনা যাচ্ছে এর কারণও হয়তো তাই।
মালবাবুকে পাওয়া গেল না। তার ঘর তালাবন্ধ। তবে জানালা খোলা। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো চলে আসবেন। জানালা দিয়ে কমলা চারটা টেবিলের উপর ছুঁড়ে দিলে কেমন হয়? দরজা খুলে কমলা দেখলে মনটা খুশি হবে। জনে-জনে জিজ্ঞেস করবেন। কমলা কে দিল? কেউ বলতে পারবে না। এটার মধ্যেও একটা মজা আছে। মালবাবু তার জন্যে অনেক করেছেন। সে কিছুই করতে পারে নি।
কোমরে চালের বস্তা পড়ে যাবার পর দুই সপ্তাহ হাসপাতালে ছিল। মালবাবু একদিন দেখতে গেল। দেখতে গেছেন এই যথেষ্ট তার উপর কুড়িটা টাকা দিলেন। হাতীর দিলের মত বড় দিল না হলে এটা সম্ভব না। সামান্য কমলা দিয়ে এই ঋণ শোধ হবার না। এরচে বেশি সে করবেই বা কী?
টেবিলে কমলা ছুঁড়ে দেবার পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত বাতিল করতে হল। মালবাবু রেগেও যেতে পারেন। তার মেজাজের কোনোই ঠিক-ঠিকানা নেই। মেজাজ ঠিক থাকলে ফেরেশতা, বেঠিক হলে শয়তানের বাদশা। মেজাজ ঠিক না থাকারই কথা। মালামাল মোটেই চলাচল হচ্ছে না। পরশু রাতেই হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন, অফিসের সামনে শুয়ে থাকস ক্যানরে হারামজাদা? লাথি খাইতে মন চায়? পেট গলায়ে দিব। বদের হাড্ডি।
থাক কমলা চারটা বরং অনুফাকে দিয়ে আসা যাক। খুশি হবে। এর মধ্যে দোষের কিছু নেই। সে নিজে দোষের কিছু দেখছে না।
অনেকদিন অনুফাকে দেখতে যাওয়া হয় না। ছয় মাসের উপর তো হবেই অবশ্যি এর মধ্যে দুবার সে গিয়েছে। ঘরে লোক আছে শুনে চলে এসেছে। সকালবেলা লোজন থাকবে না, তখন যাওয়া যায়। তাকে দেখলে অনুফা খুশি হয়। মুখে কিছু বলে না তবে সে বুঝতে পারে। অবশ্যি কিছুটা লজ্জাও পায়। লজ্জা পাওয়ার তেমন কিছু নেই। যা হচ্ছে সব আল্লাহর হুকুমেই হচ্ছে এটা জানা থাকলে লজ্জা চলে যাবার কথা। জগৎ-সংসার তো এমনি এমনি চলছে না–তাঁর হুকুমে চলছে। এটা জানা থাকলে মনে আপনা-আপনি শান্তি চলে আসে। অনুফাকে এই কথাটা গুছিয়ে বলতে হবে। অনুফার সামনে সে অবশ্যি গুছিয়ে কিছু বলতে পারে না। তার নিজেররা কেন জানি লজ্জালজ্জা লাগে। কথা বলবার সময় বেশিরভাগ কথাই গলা পর্যন্ত এসে আটকে যায়। সবচে মুশকিল হল ইদানীং অনুফা তাকে আপনি-আপনি করে বলে। যেন সে একজন মান্যগণ্য লোক। বাইরের কেউ।