ইয়াদ আলি যখন এসেছে তখন একটা অঘটন ঘটবেই। সবাই মনে-মনে তার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। জয়নাল জোঁকের মতো ইয়াদ আলির পেছনে লেগে রইল। আজ সে কী করে তা দেখা দরকার।
ইয়াদ আলি ভৈরব লাইনের গাড়িতে উঠে বসল। সেকেন্ড ক্লাস কামরা। যাত্রী বোঝই। নতুন বিয়ে হওয়া বর-কনে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। কামরা ওরাই রিজার্ভ করে নিয়েছে। শুধু এই কামরাই না পাশের একটা কামরাও রিজার্ভ। ইয়াদ আলি গাড়িতে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে দু তিনজন হা-হা করে উঠল— রিজার্ভ রিজার্ভ।।
ইয়াদ আলি মধুর হেসে বলল, এটা যে রিজার্ভ সেটা জানি ভাই। জেনে শুনে উঠলাম।
নামুন নামুন।
নেমে যাব। গাড়ি চলার আগে নেমে যাব। শুধু একটা কথা বলার জন্যে উঠেছি।
কোনো কথা না নিচে যান।
এত অস্থির হলে তো ভাই চলে না। কী বলতে চাই এটা শুনেন। মসজিদ বানাবার জন্যে আমি চান্দা চাইতে আসি নাই। আপনাদের কাছে কোনো সাহায্য চাইতে আসি নাই। আপনারা আমাকে কি সাহায্য করবেন? আপনাদের নিজেদেরই সাহায্য দরকার। আমি একজন বয়স্ক মানুষ, আমার শরীরটাও ভালো না। সামান্য দুটা কথা বলতে এসেছি, না শুনেই আপনারা চেঁচাচ্ছে–নামুন নামুন। এটা কী ধরনের কথা? এটা কি ভদ্রলোকের কথা? আপনারা সব সময় মনে করেন ট্রেনে কেউ দুটা কথা বলতে চায় মানে ভিক্ষা চায়। ভাই, আমাকে কি ভিক্ষুক বলে মনে হয়? এই কি আমাদের শিক্ষা? এই কি…
ইয়াদ আলির মুখ দিয়ে কথার তুবড়ি বেরুতে লাগল। বরযাত্রী হতচকিত। কেউকেউ খানিকটা লজ্জিত। একজন বলল, কিছু মনে করবেন না। যা বলতে চান বলুন।
না, আমি কিছুই বলতে চাই না। বলার ইচ্ছা ছিল। আপনাদের দেখে ভদ্রলোক বলে মনে হয়েছিল। ভাবছিলাম মনের ব্যথার কথাটা বলি…
এই পর্যায়ে ইয়াদ আলি থর-থর করে কাঁপতে লাগল। মনে হচ্ছে সে রাগ সামলাতে পারছে না। মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে। ইয়াদ আলি কথা বন্ধ করে এক হাতে বুক চেপে বলল, শরীরটা যেন কেমন লাগছে। এক গ্রাস পানি, এক গ্রাস পানি। বলতে-বলতে মাথা চক্কর দেয়ার ভঙ্গি করে সে লম্বালম্বি ভাবে কয়েকজনের গায়ে পড়ে গেল। দারুণ হৈ চৈ। সবাই চেঁচাচ্ছে-পানি পানি। হার্ট অ্যাটাক। হার্ট অ্যাটাক। ডাক্তার কেউ আছে, ডাক্তার?
এই ভিড় এবং হট্টগোলের মাঝে ইয়াদ আলির সাগরেদ কনের দুটি সুটকেস নামিয়ে ফেলল। নামাল সবার চোখের সামনে কেউ তা দেখলও না। জয়নাল শুধু বলল,
ব্যাটা সাবাস।
ট্রেন ছাড়ার আগ মুহূর্তে ইয়াদ উঠে বসল। বলল, শরীরটা একটু ভালো লাগছে। সবাই ধরাধরি করে তাঁকে নামিয়ে দিল।
ঘটনার এক দিন পরই দারুণ হৈ চৈ। পুলিশ এসে জয়নালের মতো যে কজনকে পেল সবাইকে ধরে নিয়ে গেল। জানা গেল ইয়াদ আলির দল একত্রিশ ভরি সোনার অলংকার নিয়ে সরে পড়েছে। কনের কানে সামান্য দুল ছাড়া অন্য কোনো অলংকার ছিল না। সব স্যুটকেসে ভরা ছিল।
বরের আপন মামা পুলিশের আইজি। তিনি প্রচণ্ড চাপ দিলেন। সেই চাপে গৌরীপুর ইস্টিশনে জয়নালের মত সবাই গ্রেফতার হয়ে গেল। মজা মন্দ না। দোষ কে করে আর শাস্তি হয় কার!
পুলিশের কাজকর্মও চমৎকার। কিছু জিজ্ঞেস করবার আগে খানিকক্ষণ পিটিয়ে নেবে। আরে বাবা কিছু প্রশ্ন কর। প্রশ্নের উত্তরে কী বলে মন দিয়ে শোন। সেটা পছন্দ না হলে তারপরে পেটাও। তা না প্রথমেই মার। রুলের গুঁ। রুলের যে এমন ভয়াবহ জয়নালের ধারণাতেও ছিল না। গুঠ বসানো মাত্র বাবারে মারে বলে চিৎকার করা। ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। তাও ভালো, পুলিশের কারণে বাপ মার কথা মনে পড়ল। পুলিশের গুনা খেলে মনে পড়ত না। এই দিক দিয়ে বিবেচনা করলে বলতেই হয় পুলিশ একটা সৎকাজ করেছে। পিতামাতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। এতে পুলিশের কিছু সোয়াব হয়েছে বলেও তার ধারণা।
মার খেলেও জয়নাল পুলিশের উপর খুবই খুশি কারণ পুলিশ কুলি সর্দার মোবারককেও ধরেছে। শুধু যে ধরেছে তাই না বেধড়ক পিটিয়েছে। রুলের গুঁতা খেয়ে হারামজাদা রক্তবমি করেছে। এত বড় একটা জোয়ান, পুলিশের কাছে কেঁচোর মতো হয়ে গেছে—এটা দেখতেও ভালো লাগে। মোবারক শুধু যে কুলি সর্দার তাই নাগৌরীপুর ইস্টিশনের ক্ষমতাবান মানুষদের একজন। স্টেশন মাস্টারকেও তাকে সমীহ করে চলতে হয়। যদি মোবারকের সঙ্গে কখনো দেখা হয়, স্টেশন মাস্টার নরম গলায় বলেন, কি মোবারক আলো?
পনেরোটার মতো মালগাড়ির পুরানো ওয়াগন বিভিন্ন জায়গায় পড়ে আছে। এই সব ওয়াগনে দিব্যি সংসার ধর্ম চলছে। একেকটা ওয়াগন একেকটা বাড়ি। এই সবই মোবারকের দখলে। সে প্রতিটি পরিবার থেকে মাসে এক শ টাকা ভাড়া কাটে। ভাড়ার অংশবিশেষ স্টেশনের বড় অফিসাররা পায়, সিংহভাগ যায় যোবারকের পকেটে। একটা ওয়াগনে কয়েকজন দেহপসারিণী থাকে। মোরক তাদের তত্ত্বাবধায়ক। তার নিজের দুই বিয়ে। অতি সম্প্রতি আরেকটি বিয়ে করেছে। এক বিহারী বালিকা নাম রেশমী। ঐ বালিকার রূপ না-কি আগুনের মতো।
জয়নালের মত লোকজন যাদের স্টেশন ছাড়া ঘুমানোর জায়গা নেই, যারা নম্বরী কুলি নয় বা তেমন কোন কাজকর্মও যাদের নেই তারা মোরককে যমের মতো ভয় পায়। মোরকের ছায়া দেখলে তাদের আত্মা শুকিয়ে যায়।
সেই মোবারককেও পুলিশে ধরল এবং পুলিশের গুঁতা খেয়ে সে রক্তবমি করল এই আনন্দের কাছে নিজের মার খাওয়ার ব্যথা কিছুই না।
দারোগা সাহেব যখন জয়নালকে বললেন, তুই কী জানিস বল? জয়নাল বলল, হুজুর মা-বাবা (কথার কথা হিসেবে বলা। খাকি পোশাক পরা সবাইকে ঘন-ঘন হুজুর মা-বাবা বলতে হয়) আমি কিছুই জানি না। লুলা মানুষ, এই দেখেন ঠ্যাঙ-এর অবস্থা। আমার লড়নের শক্তি নাই।