শীত লাগে?
হুঁ। আয় কম্বলের নিচে আয়।
বজলু এক মুহূর্ত দেরি করল না। জয়নাল দরাজ গলায় বলল, এর পর থাইকা আমার সাথে ঘুমাইস, অসুবিধা নাই।
আইচ্ছা।
দেশ কই?
চাইলতাপুর।
বাবা জীবিত?
না।
মা?
মা আছে।
আবার বিয়া হইছে?
হুঁ।
সৎ বাপ তোরে নেয় না?
না।
চাচার সাথে ছিলি?
হুঁ।
এখন চাচাও নেয় না?
বজলু জবাব দিল না। কম্বলের উষ্ণতায় তার চোখ ভেঙে ঘুম নেমেছে। শিসের শব্দও এখন আসছে না। এই রকম অদ্ভূত একটি শব্দ হয়তোে সে শীতের কারণেই করতো। আহা বেচারা! জয়নাল ছেলেটিকে হাত বাড়িয়ে আরো কাছে টেনে নিল। ঘুমুক। আরাম করে ঘুমুক।
ট্রেনের শব্দ আসছে। এটা কোন ট্রেন? জারিয়া-ঝানজাইলের ট্রেন না-কি? আজ মনে হয় সময় মতে এসে পড়েছে। না-কি মালগাড়ি? মালগাড়ির চলাচল এখন আর আগের মত নেই। বিষয়টা কি মালবাবুকে একবার জিজ্ঞেস করলে হয়। জিজ্ঞেস করতে সাহসে কুলায় না। মালবাবুর মেজাজ খুব খারাপ। মেজাজ খারাপ, মুখও খারাপ। যা মুখে আসে বলে ফেলে। ভদ্রলোকের ছেলে এই ধরনের গালাগাল কার কাছে শিখল কে জানে। তবে মেজাজ ভালো থাকলে এই লোক অন্য মানুষ। খোঁজ-খবর করে। এটা ওটা জিজ্ঞেস করে। এই যে গরম কম্বল জয়নাল গায়ে দিয়ে আছে এই কম্বলও পাওয়া গেছে মালবাবুর কারণে। একদিন কথা নেই বার্তা নেই একটা কম্বল তার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, যা এটা নিয়ে ভাগ। হারামজাদা বান্দির পুলা তোরে যেন চোখের সামনে না দেখি।
জয়নাল মনের গভীর আনন্দ চাপা দিয়ে সহজভাবে বলার চেষ্টা করল, আমি আবার কী করলাম?
শুয়োরের বাচ্চা আবার মুখের উপরে কথা বলে। চোরের ঘরের চোর। গোলামের ঘরের গোলাম।
চোর বলায় জয়নাল কিছু মনে করে নি। চোর বার হক মালবাবুর আছে। ঐ তো কিছুদিন আগের ঘটনা—দশটা টাকা দিয়ে মালবাবু বললেন, জয়নাল যা তো পাঁচ কাপ চা নিয়ে আয়। কাপ ভালো করে ধুয়ে দিতে বলবি গরম পানি দিয়ে। জয়নাল টাকা নিয়ে ছুটে বের হয়ে গেল। তবে চায়ের দোকানের দিকে গেল না। তার সারাদিন খাওয়া হয় নি। সে মজিদের ভাতের দোকানে চলে গেল। ইরিচালের মোটা-মোটা ভাত আর মলা মাছের ঝাল তরকারী। দশ টাকায় এত ভালো খাবার সে অনেকদিন খায় নি। মলা মাছের এ রকম স্বাদের তরকারী সে এই জীবনে চাখে নি। ভাত খেতেখেতে সে ভাবছিল মজিদ ভাইয়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে। যে এমন তরকারী রাঁধতে পারে তাকে সালাম করা যায়।
মালবাবুর সামনে পরের সাত দিনে সে একবারও পড়ল না। দূরে-দূরে সরে রইল। লোকটার স্মৃতি শক্তি খুবই খারাপ। সাত দিন পর তার কিছুই মনে থাকবে না। এইটাই একমাত্র ভরসা। হলও তাই, সাত দিন পর যখন মালবাবুর সঙ্গে প্রথম দেখা হল তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, কিরে তোর খোঁজ-খবর নাই। কোথায় ছিলি?
জয়নাল বলল, শইল জুইত ছিল না। আপনে আছেন কেন? কাহিল-কাহিল। লাগতেছে।
চুপ কর হারামজাদা। আমারে কাহিল দেখায়। তোর মত অত বড় মিথুক আমি জন্মে দেখি নাই। শুয়োরের বাচ্চা সমানে মিথ্যা বলে। লাথি খাইতে মন চায়?
জয়নাল হাসে। তার বড় ভালো লাগে। পরিষ্কার বোঝা যায় মালবাবুর মনটা আজ ভাল। নিশ্চয়ই অনেক মালামাল বুকিং হয়েছে। যখন প্রচুর মালামাল বুকিং হয় তখন তার মেজাজটা ভালো থাকে। ওজনের হের-ফের করে মালবাবু পয়সা পান। কাঁচা পয়সা। কাঁচা পয়সার ধর্ম হচ্ছে মানুষের মন ভালো করা। সব সময় দেখা গেছে যার হাতে কাঁচা পয়সা তার মনটা ভালো।
তোর পায়ের অবস্থা কিরে জয়নাল?
ভালো না।
চিকিৎসা করাচ্ছিস?
বিনা পয়সায় তো চিকিচ্ছা হয় না। তিন আঙুল পেট্রোলের দাম ধরেন গিয়া পাঁচ টেকা।
পেট্রোল দিয়ে কী চিকিৎসা?
পেট্রোল হইল আপনের বাতের এক নম্বর চিকিচ্ছা।
হারামজাদা বলে কী? তুই কি মোটর গাড়ি নাকি যে তোর পেট্রোল লাগবে?
এই সব চিকিৎসা কোন শুয়োরের বাচ্চা তোদর শেখায়…
মালবাবু সমানে মুখ খারাপ করেন। জয়নালের বড় ভালো লাগে। যাদের মুখ খারাপ তাদের মনটা থাকে ভালো। যা কিছু খারাপ মুখ দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। জমে থাকছে না। ভদ্রলোকরা খারাপ কিছুই মুখ দিয়ে বলেন না। সব জমা হয়ে থাকে। তাদের জামাকাপড় পরিষ্কার, কথাবার্তা পরিষ্কার, চাল-চলন পরিষ্কার আর মনটা অপরিষ্কার। এমনই অপরিষ্কার যে সোড়া দিয়ে জ্বাল দিলেও পরিষ্কার হবার উপায় নেই।
এই জন্যেই কোনো ভদ্রলোক বিপদে পড়লে জয়নালের বড় ভালো লাগে। ভদ্রলোক বিপদে পড়ে চোখ বড়-বড় করে যখন এদিক-ওদিক চায়, ফটাফট ইংরেজিতে কথা বলে তখন বড়ই মজা লাগে। তবে ভদ্রলোকরা সহজে বিপদে পড়ে না। বিপদে পড়ে তার মতো মানুষ। ভদ্রলোক বিপদে পড়লে বিপদ কেটে বের হয়ে যেতে পারে। তারা পারে না। তারচেয়েওঁ যেটা ভয়াবহ, ভদ্রলোকরা তাদের বিপদ অন্যদের ওপর ফেলে দিতে পারে।
তিন বৎসর আগের ঘটনাটা ধরা যাক। বৈশাখ মাস। সকাল দশটায় ইয়াদ আলি তার এক নতুন সাগরেদ নিয়ে উপস্থিত। ইয়াদ আলিকে দেখেই স্টেশনে সাজ-সাজ পড়ে গেল। ইয়াদ আলি যখন এসেছে তখন কাণ্ড একটা ঘটবে। ইয়াদ হচ্ছে সারা ময়মনসিংহের এক নম্বর ঠগ। যে কোনোলোককে সে ঘোল খাইয়ে দিতে পারে। থানার ও সি-কেও সে খোলা বাজারে নিয়ে বিক্রি করে দিতে পারে। ওসি টেরও পাবে না যে, সে বিক্রি হয়ে গেছে। ইয়াদ আলি অতি ভদ্ৰ। অতি বিনয়ী। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। সুন্দর চেহারা। লোকজন বলে ইয়াদ আলি উচ্চশিক্ষিত বি, এ পাস। বিচিত্ৰ না। হতেও পারে।