ইস্টিশন হচ্ছে পাবলিকের জায়গা। গভর্মেন্টের জায়গা। এই জায়গার ওপর সবার দাবি আছে। তাছাড়া ইস্টিশনে কেউ না খেয়ে থাকে না। কিছু কিছু জুটেই যায়। আর একটু বড় হলে মাল বাওয়া শুরু করতে পারবে। একটা স্যুটকে নামালে দুটাকা। ওভারব্রিজ পার হলে পাঁচ টাকা। তেমন ভদ্রলোক হলে বাড়তি বকশিশ। অবশ্যি ভদ্রলোকও এখন তেমন নেই। সামান্য একটা দুটা টাকার জন্যে যেভাবে কথা চালাচালি করে এক-এক সময় জয়নালের ইচ্ছা করে একটা চড় বসাতে। একদিন একটা চড় বসিয়ে দেখলে হয়। চড় খেলে কী করবে? কিছুক্ষণ নিশ্চয়ই কথা বলতে পারবে না। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকবে। তারপর? তারপর কী করবে? দেখতে ইচ্ছা করে। ভদ্রলোকরা বিপদে পড়লে মজাদার কাকারখানা করে।
তার যখন বোঝ টানার ক্ষমতা ছিল তখন মজা দেখার জন্যেই ভদ্রলোকদের মাঝেমধ্যে বিপদে ফেলে দিত। একবার এক ভদ্রলোকের বিছানা বালিস ট্রাংক সে ওভারব্রিজ পার করে দিল। দুই মণের মতো বোঝ। ভদ্রলোকের হাতে একটা হ্যান্ড ব্যাগ, এটাও তিনি নিতে পারছেন না। বললেন, এই কুলি, এই ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে নে। পারবি না?
কী কথার ঢং কুলি বলেই তুই-তুই করে বলতে হবে? আর এই পলকা ব্যাগ, এইটাও হাতে নেয়া যাবে না! জয়নাল উদাস ভঙ্গিতে বলল, দেন।
পারবি তো? দেখিস ফেলে দিস না। ট্রাংকে কাচের জিনিস আছে। সামালকে যাবি।
আপনে নিজেও সামালকে সিঁড়ি দিয়া উঠবেন। বিষ্টি হইছে। সিঁড়ি পিছল। আরে ব্যাটা তুই দেখি রসিক আছিস।
দেখা গেল ভদ্রলোক নিজেও বেশ রসিক। মালামাল পার করবার পর গম্ভীর গলায় বললেন, নে তিন টাকা দিলাম। মালের জন্যে দুই টাকা। এক টাকা বকশিশ।
জয়নালের মাথায় চট করে রক্ত উঠে গেল। এই ছোটলোক বলে কী? সে অতি দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, টাকা দেওনের দরকার নাই। আপনের জন্য ফিরি।
কী বললি? টাকা দিতে হইব না?
মজা করবার জন্যেই জয়নাল উদাস গলায় বলল, টেকা পয়সা দিয়ে কী হইব কন। টেকা পয়সা হইল হাতের ময়লা।
ভদ্রলোক রেগে আগুন হয়ে বললেন, তিন টাকা তোর কাছে কম মনে হচ্ছে? সেইটা তুই বল।
ছিঃ ছিঃ কম মনে হইব ক্যান। তিন টেকা অনেক টেকা। তিন টেকায় দুই সের লবণ হয়। দুই সের লবণে একটা মাইনষের এক বছর যায়। কম কি দেখলেন? আচ্ছা তাইলে যাই।
বলেই জয়নাল আর দাঁড়াল না, বেশ গম্ভীর চালে ওভারব্রিজের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। প্রথম কিছুক্ষণ ভদ্রলোক কথা বললেন না। তারপর ব্যাকুল হয়ে ডাকতে শুরু করলেন, এই শুনে যাও। এই ছেলে এই, শুনে যাও।
জয়নালের আনন্দের সীমা রইল না। তুই থেকে তুমিতে উঠেছে। এটা মন্দকী। যে শুরুতে তাকে তুই-তুই করছিল, সেই লোক তুমি-তুমি করছে এরচে বড় বিজয় তার মতোলোক আর কি আশা করতে পারে? জয়নাল ফিরেও কাল না। ঐ লোক ছটফট করছে। মালপত্র ফেলে ছুটে আসতে পারছে না, আবার সামান্য একটা কুলি তাকে অপমান করে চলে যাবে এটাও বরদাস্ত করতে পারছে না। ভদ্রলোকের অনেক যন্ত্রণা!
একসময় এই সব মজা জয়নাল করেছে। এখন পারে না। এখন তার দশা কোমরভাঙা কুকুরের মতো। সত্যি-সত্যি তার কোমর ভাঙা। তিন-মণী কস্তা আচমকা পিঠে পড়ে গিয়ে শরীর অচল হয়েছে। একটা পা শুকিয়ে দড়ি-দড়ি হয়ে যাচ্ছে। পা মাটিতে ফেলা যায় না। ব্যথায় সর্বাঙ্গ কাঁপে। আল্লাহর কী অদ্ভুত বিচার-চালের বস্তা পড়ল পিঠে, পা হয়ে গেল অচল। একের অপরাধে অনন্য শাস্তি পাচ্ছে। পা বেচারা তো কেনো দোষ করে নি।
সকাল বিকাল দুবেলা পায়ে পেট্রোল মালিশ করলে কাজ হত। পেট্রোল হচ্ছে বাতের মহৌষধ। আর তার পা যা হয়েছে, তাকে এক ধরনের বাতই বলা চলে। কারণ অমাবস্যা পূর্ণিমায় ব্যথা হয়। বাত হচ্ছে একমাত্ৰ অসুখ যার যোগাযোগ আকাশের চাঁদের সাথে।
পেট্রোল জোগাড় করাই মুশকিল। বোতলে করে তিন আঙুল পেট্রোল একবার মোটর স্ট্যান্ড থেকে নিয়ে এলো, তার দাম পড়ল পাঁচ টাকা। কী সর্বনাশের কথা। পেট্রোলের বদলে কেরোসিন তেল মালিশ করলেও হয়। তবে কেরোসিন তেলে সে রকম ধক নেই বলে মালিশের সঙ্গে-সঙ্গে এক চামচ করে খেতে হয়। খাওয়ার সময় নাড়ি-ভুড়ি উন্টে আসে আর মুখ থেকে কেরোসিনের গন্ধ কিছুতেই যেতে চায় না।
অনেকদিন পায়ে পেট্রোল বা কেরোসিন কিছুই দেয়া হয় না বলে পায়ের অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। সারাক্ষণ যন্ত্ৰণা করে। তবে গত দুদিন কোনো যন্ত্রণা করছেন। এটা খুবই ভালো লক্ষণ। মাদারগঞ্জের পীর সাহেবের লাল সুতা পায়ে বেঁধেছে বলে এটা হয়েছে কি-না কে জানে। পীর ফকিররা ইচ্ছা করলেই অনেক কিছু করতে পারেন। তাদের জ্বিন-সাধনা থাকে।
জয়নাল মাথা থেকে সমস্ত চিন্তা ঝেড়ে ফেলে মাথাটাকে পরিষ্কার করার চেষ্টা করল। ঘুমানো দরকার। ঘুম আসছে না। ছেলেটাকে তাড়িয়ে দেয়া ঠিক হয় নি। মনের খচখচানির জন্যেই ঘুম আসছে না। মাদারগঞ্জের পীর সাহেবের কাছ থেকে ঘুমের জন্যে একটা লাল সুতা আনা দরকার। ঘুম ভাঙলে এখন আর ঘুম আসে না। বড় যন্ত্ৰণা হয়েছে।
জয়নাল পাশ ফিরে শুলো আর ঠিক তখন আগের মতো শিসের শব্দ। জয়নাল কম্বলের ভেতর থেকে মাথা বের করল। বজলু ফিরে এসেছে। আগের মতো পায়ের কাছে কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়েছে। মনে হয় কোথাও জায়গা পায় নি।
এই বজলু? এই?
শিসের শব্দ থেমে গেল। বজলু বস্তার ভেতর থেকে মাথা বের করল।
এই রকম শব্দ হয় ক্যান?
বজলু মাথা নিচু করে বসে আছে। কিছু বলছে না। ছেমরা ভয় পেল নাকি?