কি সমস্যা?
সবজন্তুর লেজ আছে। মানুষের নাই—এইটা নিয়া একটা আলাপ। বাঘ, ভালুক, সিংহ, তারপর ধরেন গিয়া টিকটিকি সবের লেজ আছে। খালি ব্যাঙ-এর নাই। এই জন্যই ব্যাঙের সাথে মানুষের বেজায় মিল। ব্যাঙ খামাখা লাফালাফি করে বড়-বড় ডাক ছাড়ে মানুষও এই রকম।
হাশেম ঠাণ্ডা গলায় বলল, জয়নাল ভাই আপনে লোকটা বেজায় চালাক।
আপনেও চালাক।
তা-ও ঠিক তয় জয়নাল ভাই শুধু চালাকিতে কাম হয় না। শক্তি লাগে। যান ইস্টিশনে যান। ইস্টিশনে গিয়া আরাম কইরা ঘুমান, আপনের ঘুম দরকার।
জয়নাল নড়ে না। একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে।
লোহার রড হাতে ঘুমটি ঘরের দিকে এগিয়ে যায় হাশেম। জয়নাল কী করবে? চিৎকার করে করে লোক জড় করবে? নাকি ইস্টিশনে গিয়ে শুয়ে পড়বে? আল্লাহ পাক তাঁর ইচ্ছামতো দুনিয়া চালান—কোনো কিছু করে সেই ইচ্ছাকে বাধা দেয়া কি ঠিক? কী করবে সে? স্টেশনে গিয়ে এসপি সাহেবকে কি বলবে-জনাব আপনেরে একটা কথা বলতে চাই। গোপন কথা। এসপি সাহেব কি শুনবেন তার কথা। সে কে? সে কেউ না। ইস্টিশনে পড়ে থাকা একজন পঙ্গু মানুষ।
রেল লাইনের স্লিপারে পা দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে জয়নাল। তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে বজলু। বজলুর বগলে ভাঁজ করা কম্বল। যে কম্বল তাকে দিয়েছিলেন মালবাবু। বড় ভালো লোক ছিলেন।
ট্রেন আসছে। ঝিক-ঝিক শব্দ হচ্ছে। লাইনে তার কাঁপন বোঝা যায়। চিটাগাং মেইল। গৌরীপুর-ময়মনসিংহ হয়ে এই ট্রেন যায় বাহাদুরাবাদঘাট পর্যন্ত। এই ট্রেন প্রতিরাতেই আসে। ট্রেনের শব্দ মিশে আছে তার রক্তে। এটি এমন নতুন কিছু নয়। সকাল থেকেই জয়নালের মনে হচ্ছে আজকের দিনটি অন্যরকম।
খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে ট্রেনের শব্দে জয়নাল ভেতর থেকে চমকে উঠল। তার হঠাৎ করে কান্না পেয়ে গেল। অনেকদিন সে কাঁদে না। আজ তার কাঁদতে ইচ্ছা করছে। বাপজানের কথা, শাহেদার কথা এবং অনুফার কথা ভেবে একটু চোখের পানি ফেললে কেমন হয়?
জয়নালের চোখে পানি এসে যায়।
বজলু নিচু স্বরে বলে, আপনে কানতেছেন?
জয়নাল শার্টের হাতায় চোখ মুছে গাঢ় স্বরে বলল, না কান্দি না। কান্দনের কী আছে? কান্দনের কিছুই নাই। বাপজান যেদিন মরল সেই দিনও কান্দি নাই আর আইজ কান্দব?
কিন্তু জয়নাল কাঁদে। ফুপিয়ে-ফুপিয়ে কাঁদে। ভেজা চোখে তাকিয়ে থাকে। ইস্টিশনের দিকে। মরবার সময় এই ইস্টিশনের হাতেই তার বাপজান তাকে তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন।
জয়নাল হাঁটতে শুরু করে।
এত কাছে গৌরীপুর জংশন, তবু মনে হয় অনেক দূর। যেন এই জীবনে সে সেখানে পৌঁছতে পারবে না।
জয়নালকে ঘিরে একদল পতঙ্গ ওড়াউড়ি করে।
মানুষ যেমন এদের বুঝতে পারে না, এরাও হয়তো মানুষকে বুঝতে পারে না।
কে জানে মানুষকে দেখে পতঙ্গরাও বিস্ময় অনুভব করে কি না?