জয়নাল অনেকগুলো টাকা খরচ করে ফেলল, নিজের জন্যে চেকচেক শার্ট কিনল। এক জোড়া স্যান্ডেল কিনল। অনুফার জন্যে লাল চাদর। একটা বড় আয়না, অনুফার ঘরে ছোট্ট একটা আয়না সে দেখেছে। বড় আয়না পেলে খুশি হবে। আয়নার সঙ্গে চিরুনি না কিনলে ভালো লাগে না। চিরুনিও কিনল। তার পরেও এক শ টাকার উপর হাত থেকে গেল। এই টাকাগুলো তো খুব বরকত দিচ্ছে। ফুরাচ্ছে না।
মাঝে-মাঝে কিছু টাকা হাতে আসে যেগুলো খুব বরকত দেয়। ফুরায় না। একবার ট্রেন থেকে একটা ছোট্ট মেয়ে হাত নেড়ে তাকে ডাকছিল, এই, এই, এই। সে অবাক হয়ে দ্রুত এগিয়ে গেল। মেয়েটা বলল, মা একে ভিক্ষা দাও।
জয়নাল হাসি মুখে বলল, আম্মাজী আমি ফকির না।
ফকির না হলেও ভিক্ষা নাও। মা একে ভিক্ষা দাও।
ট্রেন তখন ছেড়ে দিচ্ছে। মেয়েটির মা হ্যান্ডব্যাগ খুলে কোনো ভাংতি পাচ্ছেন না। মেয়ে ক্রমাগত মাকে দিল তাড়া। মা দাও না, দাও না? ভদ্রমহিলা শেষ পর্যন্ত অতি বিরক্ত মুখে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিলেন। ঐ টাকা খুব বরকত দিয়েছিল। কিছুতেই শেষ হয় না। এটা ওটা কত কী কিনল, তার পরেও দেখা গেল পকেটে কুড়ি টাকার একটা নোট রয়ে গেছে। ঠিক করল এই টাকাটা অনুফাকে দেবে। আহা বেচারি কত কষ্ট করছে থাকুক তার হাতের কুড়িটা টাকা।
অনুফা কী ভাবল কে জানে। মেয়ে মানুষের মন অন্যকিছু ভেবে বসেছিল হয়তে। কেঁদে কেটে অস্থির। কিছুতেই টাকা নেবে না। শেষ পর্যন্ত নিলই না। চোখ মুছতে-মুছতে আবার আগের মতো রাস্তার মোড় পর্যন্ত পৌঁছে দিতে এল। রাস্তার বদমায়েশ ছোকরাগুলো আগের মতো চেঁচাতে লাগল, নডি বেডি যায়। নডি বেডি যায়। ছোড়াগুলো বড় বজ্জাত। ইচ্ছা করে এদের চামড়া ছিলে গায়ে লবণ মাখিয়ে রোদে বসিয়ে রাখতে।
জয়নাল অনুফার ওখানে পৌঁছল দুপুরের কিছু আগে। পাড়ার মেয়েদের কাছে আসার জন্যে সময়টা খারাপ। ওরা এই সময় ঘরের কাজকর্ম সেরে ক্লান্ত হয়ে ঘুমায়। রাত জাগার প্রস্তুতি নেয়। অনুফাও হয়তো ঘুমুচ্ছে। কড়া নাড়লে ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলবে। দরজা খুলেই লজ্জিত ভঙ্গিতে বলবে, আপনের শইল এখন কেমুন? পায়ের বেদন কমছে।
অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর যে দরজা খুলল তার নাম অনুফা নয়। এ অন্য একটা মেয়ে। খুবই অল্প বয়স ষোল-সতেরও হবে না। চোখে মুখে এখনো কিশোরীর লাবণ্য। মেয়েটি আদুরে গলায় বলল, এইটা আসবার সময়? তা আসছেন যখন আসেন?
জয়নাল বলল, অনুফা নাই?
ও আচ্ছা অনুফা আফা? না উনি এইখানে নাই। হে তো অনেকদিন হইল ঢাকায়তা ধরেন পাঁচ-ছয় মাস। আসেন না, ভিতরে আসেন। দরজা ধরা মাইনষের সাথে গল্প করতে ভাল লাগে না।
ঢাকায় গেছে কী জইনে?
রোজগারপাতি নাই। কী করব কন? পাঁচ-ছয়জন একলগে গেছে। আমরা ছয়ঘর আছি। আসেন না ভিতরে আসেন। টেকা না থাকলে নাই। চিন-পরিচয় হউক। যেদিন টেকা হইব–দিয়া যাইবেন।
জয়নাল ঘরে ঢুকল। আগের সাজসজ্জায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এই মেয়েটা সম্ভবত শৌখিন। চৌকিতে ফুলতোলা চাদর। ঘরের মেঝে ঝকঝকে তকতকে। বড় একটা আয়নাও এই মেয়ের আছে।
বসেন। দাঁড়ায়ে আছেন ক্যান? চিয়ারে বসেন।
জয়নাল পুঁটলিটা বাড়িয়ে উদাস গলায় বলল, তুমি এইগুলো রাখ। চাদর আছে। একটা, আয়না চিরুনি আর চাইরটা কমলা।
মেয়েটা দ্বিতীয় প্রশ্ন করে না। জিনিসগুলো এক ঝলক দেখেই পুঁটলিটা চৌকির নিচে রেখে দেয়। সম্ভবত তার মনে ভয় লোকটা হঠাৎ মত বদল করে জিনিসপত্র নিয়ে চলে যেতে পারে।
আমার নাম ফুলি। এই পাড়ায় দুইজন ফুলি আছে। যখন আইবেন–জিগাইবেন ছোট ফুলি। খাড়াইয়া আছেন ক্যান? বসেন। দরজা লাগায়ে দিমু?
না ফুলি আইজ যাই।
এটা কেমুন কথা। যাইবেন ক্যান? আসছেন চিন-পরিচয় হউক।
জয়নাল কথা বাড়াল না। তার মনটা খুবই খারাপ হয়েছে। সে বেরিয়ে এল। এই মেয়েটাও অনুফার মতো সঙ্গে-সঙ্গে আসছে।
জয়নাল বলল, তুমি আসছে ক্যান? তুমি ঘরে যাও।
ফুলি আদুরে গলায় বলল, ভাংতি টেকা থাকলে দিয়ে যান। ঘরে কেরাচিন কিননের পয়সা নাই। হাত একেবারে খালি।
জয়নাল ভেবেই এসেছিল-চকচকে এক শ টাকার নোটটা অনুফাকে দিয়েআসবে। নিতে না চাইলেও জোর করে দেবে। এই মেয়ে নিজ থেকে চাইছে। অনুফার সঙ্গে তার তো তেমন কোন তফাৎ নেই। তাছাড়া এক অর্থে সব মানুষই তো এক। অনুফাকে দেয়া যে কথা এই মেয়েটিকে দেওয়াও তো তাই।।
আফনের কাছে কিছু আছে? চাইর পাঁচ টকা হইলেও হইব। না থাকলে কোনো কথা নাই। চিন-পরিচয় হইল এইটাও কম কথা না।
জয়নাল এক শ টাকার নোটটা বের করল। ছোঁ মেরে ফুলি তা নিয়ে নিল। সঙ্গে-সঙ্গে বেঁধে ফেলল আঁচলের গিটে। মেয়েটি ফিরে যাচ্ছে। জয়নালের সঙ্গে রাস্তার মোড় পর্যন্ত আসার প্রয়োজন তার নেই। এলে জয়নালের ভালো লাগতো। ঝিমধরা দুপুরে একটা মেয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকাচ্ছে মায়া-মায়া চোখে, এই দৃশ্য বড়ই মধুর।
ভালো লাগছে না। জয়নালের কিছু ভালো লাগছে না। পায়ের পুরানো ব্যথা ফিরে এসেছে। পূর্ণিমা লেগে গেছে কি-না কে জানে। মনে হয় লেগেছে, নয়ত আচমকা এই ব্যথা শুরু হত না।
জয়নাল রিকশা ডাকল। বুড়ো রিকশাওয়ালা এগিয়ে এল। এই রিকশাওয়ালাকে জয়নাল চেনে, ছমিরুদ্দিন। দুইজনই ভান করল কেউ কাউকে চেনে না। শুধু রিকশা থেকে নেমে দুটাকা ভাড়া দেয়ার সময় জয়নাল বলল, ছমিরুদ্দিন ভাইয়ের শইলডা ভালা?
ছমিরুদ্দিন বলল, ভালা।