আর পাগলা রমজান ভাই রোজই এটা সেটা এনে খাওয়াতেন। এককাপ দুধ। একটা কলা। সুজির হালুয়া। লবণ মরিচ দিয়ে মাখা ভাতের মাড়। পাশে বসে নানান কথাবার্তা বলতেন। সবই জ্ঞানের কথা। ভাবের কথা।
কষ্ট পাওয়া ভালো, বুঝলি জয়নাল। কষ্ট পাওয়া ভালো। কষ্ট হইল আগুন। আর মানুষ হইল খাদ মিশানো সানা। আগুনে পুড়লে খাদটা চলে যায়। থাকে মোনা। তোর খাদ সব চলে যাচ্ছে বুঝলি?
রমজান ভাইয়ের কথা ঠিক না। কষ্টে পড়ে সে চোর হয়েছে। আগে চোর ছিল না। বোধ হয় তার মধ্যে সোনা কিছুই ছিল না। সবটাই ছিল খাদ। হাতের পাঁচটা আঙুল যেমন সমান না সব মানুষও তেমন সমান না। কিছু-কিছু মানুষ আছে পুরোটাই সোনা আবার কিছু-কিছু মানুষের সবটাই খাদ।
যাক এসব নিয়ে তার মনে কোনোকষ্ট নাই। কারো উপর তার কোনোরাগও নাই। সে যখন শুনল অনুফা ছমিরুদ্দিন রিকশাওয়ালার কাছে বিয়ে বসেছে সে রাগ করে নি। বরং ভেবেছে ভালোই হয়েছে, মেয়েটার গতি হল। ছমিরুদ্দিন লোক খারাপ না। রোজগার ভালো। অনুফা খেতে-পরতে পারবে। তারপর শুনল আগের বউটার সঙ্গে ঝগড়ায় টিকতে না পেরে চলে গেছে, তখন কিছুদিন বড় অশান্তিতে কাটল। জোয়ান বয়স। কোথায় যাবে? কোথায় ঘুরবে? তারপর খবর পাওয়া গেল অনুফা একজন কাঠ মিস্ত্রীর কাছে বিয়ে বসেছে। কাঠ মিস্ত্রীর আগের বউ মারা গেছে। সেই পক্ষের তিন চারটা ছেলে মেয়ে ওদের মানুষ করতে হবে। বউ দরকার। এই খবরে বড় আরাম পেল জয়নাল। যাক একটা গতি হল। আগের পক্ষের বউ যখন নেই তখন বলতে গেলে সুখের সংসার। কাঠ মিস্ত্রী যখন, তখন রোজগার-পাতি খারাপ হওয়ার কথা না। মানুষের কপাল, এই বিয়েও টিকল না। নানান ঘাট ঘুরে ফিরে তার জায়গা হল পাড়ায়। তা কী আর করবে। কপালের লিখন। অবশ্যি একদিক থেকে ভালো হলস্বাধীনভাবে থাকবে। কারো মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। এই তো ভালো। ভাগ্যের উপর তো কারো হাত নেই। হাসান-হোসেনের মত পেয়ারা নবীর দুই নাতীকেও কি কুৎসিত মৃত্যু বরণ করতে হল। ভাগ্যে ছিল বলেই তো।
অনুফার কাছে যাবার আগে জয়নাল নাপিতের কাছে গিয়ে মাথার চুল কাটাল। খোঁচা খোঁচা দাড়ি গজিয়েছিল। শেভ করাল।
কেমন হালকা লাগছে নিজেকে। আয়নায় দেখাচ্ছেও অন্যরকম। গায়ের শার্টটা অতিরিক্ত ময়লা। একটা শার্ট কিনে ফেলবে নাকি? পুরানো কাপড়ে বাজার ভর্তি। পনেরো বিশ টাকায় ভালো শার্ট হয়। টাকা যখন আছে কিনে ফেললেই হয়। এক জোড়া স্যান্ডেলও দরকার। অনেক দিন ধরেই খালি পায়ে হাঁটছে। স্পঞ্জের একজোড়া স্যান্ডেলের কত দাম কে জানে? দশ টাকায় হবে না?
খালি হাতে যাওয়াটাও ঠিক হবে না। অনুফার জন্যে কিছু একটা নিতে হবে। কমলা চারটা তো আছেই, এ ছাড়াও অন্য কিছু একটা শীতের চাদর নিয়ে গেলে কেমন হয়? ফুল তোলা শীতের চাদরের খুব শখ ছিল বেচারীর। লাল রঙের চাদরে সাদা ফুল।
অনুফার কাছে কোনোবারেই সে খালি হাতে যায় নি। অতি তুচ্ছ কিছু হলেও নিয়ে গেছে। পান খেতে পছন্দ করত বলে একবার একটা পানের বাটা নিয়ে গেল। বড় খুশি হয়েছিল সেবার। খুশি হয় আবার লজ্জাও পায়। প্রথম বার যখন গেল লজ্জায় অনুফা কথা বলতে পারছিল না। সারাক্ষণ মাথা নিচু করে বসেছিল। কোনোক্রমে ক্ষীণ স্বরে বলল, আপনের শইল কেন?
আপনি ডাক শুনে জয়নালের বুকের ভেতরটা হা-হা করে উঠল। তবে সে সহজ ভাবেই বলল, ভালো। তুমি কেমন আছ?
যেমন দেখছেন।
খুব ভালো আছে বলে জয়নালের মনে হল না। অনুফার চোখের নিচে কালি। মুখ শুকনা। মাথার চুলগুলোও কেমন লালচে-লালচে। তবু সুন্দর লাগছিল অনুফাকে।
অনুফা বসেছিল জলচৌকিতে। জয়নাল চৌকির ওপর। চৌকিতে পাটি বিছানো। এক কোণায় তেলচিটচিটে বালিশ। ঘরের পাশ দিয়েই বোধহয় নর্দমা গেছে। দুর্গন্ধে নাড়িতুড়ি উন্টে আসে। ঘরের এক কোণায় ভোলা উনুনের পাশে লম্বা-লম্বা সবুজ রঙের বোতল। বোতলগুলোর দিকে তাকিয়ে জয়নাল ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলতেই অনুফা বলল, অনেক কিসিমের মানুষ আসে। মদ খাইতে চায়। এরাই বোতল আনে। আমি শেষে বোতল বেইচা দেই।
তুমি খাও না তো?
না।
খুব ভালো। ভুলেও খাইবা না। মদ হইল গিয়া নিশার জিনিস। একবার নিশা হইলে আর ছাড়তে পারব না। শইল নষ্ট হইব।
আমি খাই না।
না খাওনই ভালো।
এরপর জয়নাল আর কথা খুঁজে পায় না। কথা খুঁজে পায় না অনুফাও। দুজনই অপরিচিত মানুষের মতো মুখোমুখি বসে থাকে। একসময় জয়নাল বলে, উঠি কেমুন?
অনুফা লাজুক স্বরে বলে, আর একটু বসেন।
আইচ্ছা বসি।
অনুফা উঠে গিয়ে কোত্থেকে যেন চা নিয়ে আসে। সঙ্গে ছোট্ট পিরিচে একটা নিমকি, একটা কালোজাম। নিমকি, কালোজাম এবং চা জয়নাল খায়। না খেলে মনে দুঃখ পাবে। এত কষ্টের পয়সার রোজগার।
ফেরবার সময় হেঁটে হেঁটে অনুফা তাকে অনেক দূর এগিয়ে দেয়। জয়নাল বলে, যাও গিয়া আর আস কেন? ঘর খোলা।
অনুফা উদাস স্বরে বলে, থাকুক খোলা। ঘরে আছেই কী, আর নিবই কী?
অনুফা একেবারে সদর রাস্তা পর্যন্ত আসে। দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তার মোড়ে। জয়নাল যতবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় ততবারই দেখে অনুফা দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় ঘোমটা।। অনুফার চোখ বড় মায়াময় মনে হয়। তাকে গৃহস্থ ঘরের বৌয়ের মতোই লাগে। পাড়ার মেয়ে বলে মনে হয় না।
রাস্তার চেংড়া ছেলেপুলেরা অনুফাকে দেখিয়ে অশ্লীল ইঙ্গিত করে। সুর করে বলে, নডি বেডি। ন-ডি- বেডি। অনুফার তাতে কোনো ভাবান্তর হয় না।