এখন বাইরের কেউ হলেও এক সময় তো ছিল না। রীতিমতো কাজি সাহেব ডেকে বিয়ে পড়ানো হল। সেই বিয়েতে নগদ খরচ হল সাড়ে তিন শ। তাও বিয়ের শাড়ি কিনতে হল না। মালবাবু শাড়ি কিনে দিলেন এবং মুখ বিকৃত করে বললেন, হারামজাদা বিয়ে যে করলি, বউকে খাওয়াবি কী? বাতাস খাওয়াবি? ছোট লোকের বুদ্ধি-শুদ্ধি হয় না, এটা একেবারে সত্যি কথা। বৎসর না ঘুরতেই বাচ্চা পয়দা করে ফেলবি। পরের বৎসর আরেকটা, তার পরের বৎসর আরেকটা। আবার হাসে। লাথি দিয়া হারামজাদা তোর দাঁত ভাঙব। হাসবি না।
তা হাসি আসলে সে কী করবে। হাসি-কান্না এগুলো একবার আসতে শুরু করলে ফট করে থামানো যায় না। তখন মনে খুব ফুর্তি ছিল। এতগুলো টাকা ঋণ হল। সবটাই জোগাড় হল সুদীতে। টাকায় টাকা সুদ। কুলি সর্দারের কাছ থেকে নেয়া। তাঁর কাছে সুদে টাকা নেয়া মানে সারাজীবনের জন্যে বান্ধা পড়া। সুদ দিয়েই কূল পাওয়া যাবে না আসল দিবে কখন। তবু জয়নাল সব তুচ্ছ জ্ঞান করল। তখন শরীরে শক্তি ছিল। দুই মণী বোঝ হাচকা টান দিয়ে তুলতে পারত। ইস্টিশনের কাজ ছাড়াও বাইরে কাজ ছিল। সড়ক তৈরির কাজ। দিনে করত সড়ক তৈরির কাজ। তখন গৌরীপুর-শম্ভুগঞ্জ সড়কে মাটি কাটা হচ্ছে। কাজের অভাব নেই, শরীরে শক্তি থাকলে কাজ আছে। সন্ধ্যার পর চলে আসত স্টেশনে, এখানেও মাল তোলার কাজ আছে। অবশ্যি রোজগারের সবটাই কুলি সর্দার নিয়ে নিত। টাকায় টাকা সুদ, দিতে গিয়েই শরীরের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যায়। তার ওপর সে একটা ঘর নিয়েছে। গৌরীপুরের রাজবাড়ির কাছে একটা ছনের ঘর। ছমিরুদ্দিন রিকশাওয়ালার ঘরের একটা অংশ। স্টেশন থেকে খানিকটা দূর। তাতে কি? হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতে তার মজাই লাগতো।
হেঁটে বাড়ি ফিরতে সে নানান ধরনের স্বপ্ন দেখতে। সুদের টাকা সবটা ফেরত দেয়া হয়েছে। তার পর টাকা জমাচ্ছে। টাকা জমিয়ে একদিন একটা রিকশা কিনে ফেলল। সেই রিকশা সে নিজে চালায় না। ভাড়া খাটায়। তখন টাকা জমে দুদিক থেকে তার টাকা এবং রিকশার টাকা। জমতে জমতে অনেক হয়ে গেল। তখন তারা জমি কিনল। ব্ৰহ্মপুত্র নদীর তীরে প্রথমে ছোট্ট এক টুকরা জমি। তারপর আরেকটু, তারপর আরেকটু। একটা ঘর তুলল। টিনের ঘর। ঘরের চারপাশে ফল-ফলান্তির গাছ। পিছনে বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড় ছাড়া ঘরবাড়ি ভালো হয় না। ঘরবাড়ির আব্রু থাকে না। কল্পনার এই পর্যায়ে সে বাড়ি পৌঁছে যায়। মনে হয় পথটা আরেকটু দীর্ঘ হল না কেন? আরেকটু দীর্ঘ হলে ভালো হত। আরো কিছুক্ষণ ভাবা যেত। পথে নামতেই পথ ফুরিয়ে যায়, এও এক আশ্চর্য কাণ্ড।
তার পায়ের শব্দে দরজার ঝাঁপ সরিয়ে অনুফা বের হয়ে আসে। নিচু গলায় বলে আইজ অত দেরি হইল ক্যান?
রোজ একই প্রশ্ন। একদিন সে সন্ধ্যায় চলে এসেছিল। সেদিনও বলল, আইজ অত দেরি হইল ক্যান? জয়নাল হেসে বলল, এরে যদি দেরি কও তা হইলে যে বউ ঘরেই বইস্যা থাকন লাগে।
থাক না ক্যান? একটা পুরা দিন ঘরে থাকলে কী হয়?
টেকা জমান দরকার, অনুফা টেকা জমান দরকার।
টাকা অবশ্যি কিছু জমতে শুরু করল। বাঁশে ফুটো করে আজ এক টাকা, কাল দুটাকা এমনি করে ফেলতে লাগল। একবার ফেলল বিশ টাকার একটা নোট। বড় সুখের সময় ছিল।
দুজনে একবার ছবিঘরে একটা বইও দেখে এল। অনেক শিক্ষণীয় জিনিস ছিল বইটাতে। দেবর ভাবীর সংসার। দেবর তার ভাবীকে মায়ের মতো শ্ৰদ্ধা করে। ভাবীও বড় স্নেহ করেন দেবরকে। ভাত মাখিয়ে মুখে তুলে দেন। এই দেখে স্বামীর মনে হল খারাপ সন্দেহ। তাঁর মনে হল দুইজনের মধ্যে ভালবাসা হয়ে গেছে। তিনি দুজনকেই বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। তারা পথে-পথে ঘুরে গান গায়, ভিক্ষা করে। খুব করুণবই। কাঁদতে-কাঁদতে অনুফা অস্থির। জয়নাল নিজেও কাঁদছে। দেবর ভাবীর দুঃখ সেও সহ্য করতে পারছে না। তবে একটা দিক ভেবে তার ভালো লাগছে এ জাতীয় সমস্যা তার নেই। সে
বেশি সুখ কারো কপালে লেখা থাকে না। এটাও আল্লাহতালার বিধান। কাজেই অঘটন ঘটল। চালের বস্তা পড়ে গেল কোমরে। দুনিয়া অন্ধকার হয়ে গেল। কাউকেই সে দোষ দেয় না। সবই কপালের লিখন। কথায় বলে না, কপালের লিখন না যায় খণ্ডন।
তার কপালে লেখাই ছিল কোমরে পড়বে তিনমণী চালের বস্তা, তারপর অনুফা তাকে ছেড়ে চলে যাবে। অনুফার উপরও তার রাগ নেই। যে স্বামী খেতে পরতে দেয়। না, খামাখা তার গলায় ঝুলে থাকবে কেন? তাছাড়া গায়ের রঙ ময়লা হলেও চেহারা ছবি ভালো। কোনো পুরুষ মানুষ একবার তাকে দেখলে, দ্বিতীয়বার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। সেই পুরুষের চোখ চকচক করে। এই মেয়ের কি দায় পড়েছে জয়নালের সঙ্গে লেপ্টে থাকার? জয়নালের তখন এখন মরে তখন মরে অবস্থা। হাসপাতালে থেকে। কিছু হয় নি বলে চলে এসেছে স্টেশনে। একটা পয়সা নেই হাতে। মাথার ভেতরে সবসময় ঝুমঝম করে ট্রেন চলে। কিছু মুখে দিলেই বমি করে ফেলে দিতে ইচ্ছা করে। মাঝে-মাঝে মনে হয় হঠাৎ যেন কেউ সারা গায়ে এক লক্ষ সুচ ফুটিয়ে দিল। সে তখন বিড়বিড় করে বলে—ভাই সকল আপনেরা ধরাধরি কইরা আমারে লাইনের উপরে শুয়াইয়া দেন। আমার জীবনটা শেষ হউক। কেউ তাকে লাইনের উপর শুইয়ে দেয় না বলে জীবন শেষ হয় না। মালবাবুর অফিসের সামনে ময়লা বস্তার উপর সে শুয়ে থাকে। আর ভাবে জীবন জিনিসটা এমন জটিল কেন?
সেবার সে মরেই যেত। বেঁচে গেল দুটা মানুষের জন্যে। মালবাবু আর রমজান। ভাই। মালবাবু কয়েকদিন পরপর ডাক্তার নিয়ে আসতেন। কঠিন গলায় বলতেন, একটা ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলুন তো ডাক্তার সাহেব। মারতে পারলে এক শ টাকা দেব। এরকম কষ্ট ভোগ করার কোনো অর্থ নাই। আগাছা পরিষ্কার হওয়া দরকার। এগুলো হচ্ছে আগাছা। আপনি ইনজেকশন দিয়ে না মারলে আমি নিজেই লাঠি দিয়ে বাড়ি দিয়ে মাথা দুফাঁক করে দেব। মুখে এসব বলতেন আর ভেতরে টাকা দিয়ে অষুধ কিনতেন। দামী দামী ওষুধ। টাকা তাঁর কাছে ছিল হাতের ময়লা।।