ঈস! কিশোর সভয়ে বলল, লোকটি এখনই পড়ে মরবে যে!
মরুক; দুনিয়ার একটা পাপ বিদায় হবে, গেরুয়াধারীর কষ্ঠ অবিচলিত, তুমি বোধহয় নগরীতে নবাগত, তাই ওকে জানো না। ও হচ্ছে রত্নাকর বণিক। অত্যন্ত লোভী হীনচেতা ব্যক্তি।
-বাঁচাও। সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দেব।
অশ্বপৃষ্ঠ থেকে আবার ভেসে এল আর্তচিৎকার। পরক্ষণেই সেই আর্তনাদকে ডুবিয়ে জাগল অশ্বের তীব্র হেষাধ্বনি।
সহস্র স্বর্ণমুদ্রা? কিশোর বিস্মিত স্বরে বলে উঠল।
সহস্র স্বর্ণমুদ্রা রত্নাকরের কাছে কিছুই নয়, গেরুয়াধারী মন্তব্য করল, কিন্তু সহস্র স্বর্ণমুদ্রার জন্য প্রাণবিপন্ন করবে কে?
পিছন থেকে ভেসে এল উত্তেজিত কণ্ঠস্বর, আমি।
চমকে উঠে কিশোর দেখল তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে জয়দ্ৰথ। দারুণ উত্তেজনায় তার চোখ জ্বলছে এবং হাত হয়েছে মুষ্টিবদ্ধ।
জয়দ্রথ উত্তেজিত স্বরে বলল, অর্থের পরিমাণ কম নয়। সহস্র স্বর্ণমুদ্রার জন্য আমি বাঘের গুহায় প্রবেশ করতে পারি।
আবার ভেসে এল আর্তনাদ, বাঁচাও! সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দেব। ভয় নেই, চিৎকার করে উঠল জয়দ্ৰথ, আমি তোমাকে রক্ষা করব। পরক্ষণেই সে তীরবেগে ছুটল ধাবমান অশ্বের দিকে। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু, অত্যন্ত দুঃখিত স্বরে মন্তব্য করল গেরুয়াধারী, জগতে অর্থই। সকল অনর্থের মূল।
.
০৪. নগরে নেকড়ের হানা
ছুটতে ছুটতে অশ্বের কাছাকাছি এসে পড়ল জয়দ্ৰথ, তবু শেষরক্ষা হল না। এক ঝটকায় পিঠের জীবন্ত বোঝাকে ছিটকে ফেলে অশ্ব হ্রেষাধ্বনি করে উঠল। রত্নাকর বণিক মাটিতে পড়ে গড়াতে লাগল প্রকাণ্ড এক কুণ্ডের মতো। আর জ্বলন্ত দুই চোখের নির্নিমেষ দৃষ্টি মেলে তাকে লক্ষ করতে লাগল অশ্ব। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে হাতে ভর দিয়ে রত্নাকর উঠে বসল তৎক্ষণাৎ ভীষণ চিৎকার করে দুরন্ত পশু ছুটে এসে পিছনের পায়ে খাড়া হয়ে উঠল।
দারুণ আতঙ্কে দুই চোখ মুদে ফেলল রত্নাকর- এই বুঝি সামনের দুই খুর একজোড়া লৌহমুষলের মতো এসে পড়ে তার দেহের উপর।
একটা তীব্র হেষাধ্বনি কানে এল, রত্নাকরের বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠল– কিন্তু নাঃ! অশ্বের পদাঘাতে তো তার দেহের উপর পড়ল না।
আবার, আবার জাগল সেই তীব্র হ্রেষাধ্বনি! কানের পর্দা বুঝি ফেটে যাওয়ার উপক্রম। তবুও দেহের উপর কোনো আঘাত অনুভব করে না রত্নাকর বণিক।
আবার হ্রেষাধ্বনি। স্বর এবার মৃদু, স্তিমিত। তার পরই কানে আসে মনুষ্যকণ্ঠের আওয়াজ, এ যে দেখছি খুনী জানোয়ার। আরোহীকে পিঠ থেকে ফেলেও স্বস্তি নেই–মানুষটাকে পদদলিত করতে চায়।
খুব ধীরে ধীরে আর ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে ফেলল রত্নাকর। দেখল, অশ্বের বলগা ধরে দাঁড়িয়ে আছে ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিত এক প্রকাণ্ড পুরুষ। লোকটির দেহের শক্তি নিশ্চয়ই অসাধারণ বলগার আকর্ষণে তেজস্বী অশ্ব স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে; শুধু ফুরিত নাসারাঙ্কু ও জ্বলন্ত চক্ষুর হিংস্র দীপ্তি থেকে প্রকাশ পাচ্ছে জানোনায়ারের দুরন্ত আক্রোশ।
রত্নাকর সোজা হয়ে উঠে বসল। সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ চিৎকার করে জন্তুটা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করল।
সভয়ে চেঁচিয়ে উঠল রত্নাকর, সাবধান! হাত ফসকালেই বিপদ! একবার যদি—
রত্নাকরের মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই ক্রুদ্ধ অশ্ব আক্রমণ করল। না, রত্নাকরকে নয় যে বলিষ্ঠ-দর্শন মানুষটি অশ্বের বলগা ধারণ করেছিল, মুহূর্তের জন্য বুঝি শিথিল হয়েছিল তার মুষ্টি, এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অশ্ব হাতটা কামড়ে ধরল।
উঃ! তুমি শুধু পদাঘাতেই পটু নও, দংশনেও বিলক্ষণ দক্ষ।
ব্যাঘ্রচর্মে সজ্জিত বিশালদেহী পুরুষ তার ডান হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল না, বাঁহাত দিয়ে মল্লযোদ্ধার অভ্যস্ত কৌশল অশ্বের নাসিকায় প্রচণ্ড আঘাত হানল, তোমার জানা উচিত মল্লযোদ্ধার হাত অশ্বের ভক্ষ্য নয়।
অস্ফুট আর্তনাদ করে অশ্ব হাত ছেড়ে দিল। তৎক্ষণাৎ আবার বজ্রমুষ্টিতে ধরা পড়ল অশ্বের বলগা। আরক্ত চক্ষে একবার হ্রেষাধ্বনি করে অশ্ব স্থির হয়ে গেল। সে বুঝেছে, এ বড়ো কঠিন ঠাই।
অশ্ব ও মানুষের দ্বৈরথ-রণ দেখতে দেখতে পার্শ্ববর্তী গেরুয়াধারীকে উদ্দেশ্য করে কিশোর বলে উঠল, জয়দ্রথ শেষ পর্যন্ত অশ্বকে ধরে ফেলল! দেখুন, দেখুন! ক্ষিপ্ত অশ্বের আবির্ভাবে যে-সব পথচারী আড়ালে সরে গিয়েছিল, তারা আবার নির্ভয়ে মুক্ত রাজপথের উপর এসে দাঁড়িয়েছে- আরে! ওরা আবার কারা!
রাজপথে শুধু পলাতক পথিকরাই ফিরে আসে নি, আরও একদল বিচিত্র মানুষ আবির্ভূত হয়েছে সেখানে। তাদের কটিবন্ধে তরবারি, বাম হস্তে লৌহদস্তানা।
গেরুয়াধারী গম্ভীরভাবে উত্তর দিল, দ্বিপদ নেকড়ে।
–দ্বিপদ নেকড়ে?
হ্যাঁ। কিন্তু বনবাসী চতুষ্পদ নেকড়ের চাইতে এই দ্বিপদ নেকড়ের দল অনেক বেশি ভয়ংকর। ওরা রত্নাকর বণিকের দেহরক্ষী অর্থাৎ বেতনভোগী দস্যু। নগরের বাসিন্দারা ওই দুর্বৃত্তদের ভালোভাবেই জানে। তুমি নগরীতে নবাগত বলেই ওদের জানো না।
-রত্নাকর আর তার সহচর দুর্বৃত্তদের নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে চাই না। আমি কথা বলতে চাই জয়দ্রথের সঙ্গে। এখন রত্নাকরের সঙ্গে ওর পুরস্কারের ব্যাপারটা মিটে গেলেই–
–অত সহজে ব্যাপার মিটবে না। জয়দ্রথের সঙ্গে তোমার কথা বলার সুযোগ হবে কি না সন্দেহ। বিপদ কেটে যাওয়ার পর রত্নাকর বণিক অত টাকা দিতে রাজি হবে বলে মনে হয় না।