আসুন, এগিয়ে আসুন, উচ্চৈঃস্বরে হাঁক দিল জয়দ্ৰথ, এই লৌহদণ্ড কতখানি কঠিন পরীক্ষা করে দেখুন।
এবারও কেউ এগিয়ে এল না। সিন্দুক তুলতে গিয়ে তারা ঠকেছে, দ্বিতীয়বার বিফল হয়ে জনতার হাসির খোরাক হতে রাজি নয়। আচ্ছা, বুঝলাম আমার কথাতেই আপনারা বিশ্বাস করছেন। তবু আমি অন্তত একজনকে এটা পরখ করতে বলব।
এগিয়ে এসে জয়দ্রথ কিশোরের সামনে লৌহখণ্ড প্রসারিত করল। বলল, দেখ। এই লৌহখণ্ডকে যদি কেউ হাতের চাপে বাঁকা করতে পারে, তবে তাকে অসীম শক্তিশালী বলা যায় কি না।
বলিষ্ঠ মানুষের কবজির মতো স্থূল সেই লৌহদণ্ডের দিকে তাকিয়ে কিশোর মাথা নাড়ল, প্রয়োজন নেই। দণ্ডের আকৃতি আর স্থূলত্বই ওর কাঠিন্য প্রমাণ করছে।
-তবু দেখ।
কিশোর হাত বাড়িয়ে লৌহদণ্ড গ্রহণ করল। বস্তুটির ওজন অনুভব করেই সে বুঝল এই দণ্ড হাতের চাপে বাঁকানো সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। দুই প্রান্ত ধরে একবার চাপ দিয়ে সে দণ্ড ফিরিয়ে দিল জয়দ্রথের হাতে।
লৌহদণ্ডটি হাতে নিয়ে মণ্ডলাকারে দণ্ডায়মান জনতার মাঝখানে দাঁড়াল জয়দ্রথ, হাঁক দিয়ে বলল, দেখুন।
দণ্ডের দুই প্রান্ত ধরে শক্তি প্রয়োগ করল সে। জনতা দেখল, তার কঁধ ও বাহুর উপর জেগে উঠেছে সাবলীল মাংসপেশীর তরঙ্গ।… দণ্ড তখনও অবিকৃত!… পেশীগুলি আরও স্ফীত হয়ে উঠল, সর্বাঙ্গ আর মুখ হল রক্তবর্ণ, ললাটে জাগল কুঞ্চনরেখা…
জনতা সবিস্ময়ে দেখল সেই অতি স্থূল দণ্ড ধীরে ধীরে বক্রাকার ধারণ করছে।
কিশোরের মুখে হাসির রেখা দেখা দিল। আপনমনেই মাথা নেড়ে সে বলে উঠল, হ্যাঁ, জয়দ্রথ অসাধারণ বলবান বটে।
পিছন থেকে ভেসে এল পরিচিত কণ্ঠস্বর, অসাধারণ না হলেও বলবান বটে।
সক্রোধে গেরুয়াধারীর দিকে ফিরে দাঁড়াল কিশোর, আপনি গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী, শক্তিমানের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে জানেন না।
-গৈরিকধারণ করলেই সন্ন্যাসী হয় না। আর প্রাপ্য মর্যাদার কথা যদি বলল, তাহলে বলব যার যতটুকু প্রাপ্য ততটুকুই আমি দিতে প্রস্তুত, তার বেশি নয়।
–শক্তিমানের প্রাপ্য মর্যাদা শক্তিমানই দিতে পারে। স্থলোদর মেদসর্বস্ব সন্ন্যাসীর পক্ষে অপরের শক্তির পরিমাপ করা সম্ভব নয়।
-ওহে বালক! আমি মেদসর্বস্ব নই। তুমি এখনও মানুষের দেহ দেখে তার শক্তির পরিমাপ করতে শেখ নি।
গেরুয়াধারীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিদ্রূপতীক্ষ্ণ কণ্ঠে কিশোর বলল, আপনি বলতে চান আপনাকে দেখে আপনার দৈহিক শক্তির পরিমাপ আমি করতে পারি নি? ভালো, এখন বলুন তো, হে শক্তিমান সন্ন্যাসী! ওই লৌহদণ্ড কি আপনি হাতের চাপে বক্র করতে সমর্থ?
কিশোরের বলার ভঙ্গি ও ভাষা অত্যন্ত অপমানকর, কিন্তু গেরুয়াধারীর মুখে ক্রোধের আভাস মাত্র নেই, ওই লৌহদণ্ড আমি বাঁকিয়ে দিতে পারি অনায়াসে।
–আর ওই নিরেট সিন্দুক? ওটিকেও আপনি মাথার উপর তুলতে পারেন নিশ্চয়?
–নিশ্চয়ই পারি।
–তবে একটু আগে জয়দ্রথ যখন জনসমক্ষে সবাইকে শক্তির পরীক্ষা দিতে আহ্বান করেছিল, তখন আপনি চুপ করে ছিলেন কেন?
–প্রয়োজন মনে করিনি। অনর্থক শক্তিক্ষয়ে আমার রুচি নেই।
–বেশ। অনর্থক শক্তিক্ষয় করতে যখন আপনার আপত্তি, তখন অর্থের বিনিময়ে আপনার ক্ষমতার পরিচয় দিন। আমি আপনাকে এখনই একটি সুবর্ণমুদ্রা দেব যদি ওই সিন্দুক আপনি মাথার উপর তুলতে পারেন।
গেরুয়াধারীর দুই চোখে মুহূর্তের জন্য বিস্ময়ের চমক দেখা গেল, পরক্ষণেই আত্মসংবরণ করে সে বলল, অর্থ পেলে মন্দ হয় না। বিশেষত একটি স্বর্ণমুদ্রার প্রলোভন সংবরণ করা আমার ন্যায় দরিদ্র ব্যক্তির পক্ষে খুবই কঠিন। কিন্তু এখানে শক্তির পরীক্ষা দিলে জয়দ্রথের ক্ষতি হবে। এটা তার জীবিকা। আমি কারও জীবিকার ক্ষতি করি না।
ওঃ! কিশোরের কণ্ঠে স্পষ্ট বিদ্রূপ, আপনি অতি মহাশয় ব্যক্তি। তবে মন্দলোকে হয়তো আপনাকে ধূর্ত বাক্যবীর বলেও মনে করতে পারে।
তা মনে করতে পারে বটে।
গেরুয়াধারীর মুখের হাসি আরও প্রশস্ত হল। শ্লেষ ও বিদ্রূপ তাকে স্পর্শ করেছে বলে মনে হল না। কিশোর কি যেন বলতে গেল, তার আগেই জনতার হর্ষধ্বনিতে চমকে সে জয়দ্রথের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল লৌহদণ্ড প্রায় গোলাকার ধারণ করেছে।
এই অসাধারণ শক্তির পরিচয় কিশোরকে মুগ্ধ করে দিল। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে গেরুয়াধারীকে লক্ষ করে আর একটি শ্লেষতিক্ত বিদ্রূপবাণ নিক্ষেপ করতে উদ্যত হল, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে জনতার পিছন থেকে এক প্রচণ্ড কোলাহল ভেসে এসে তার উদ্যত জিহ্বাকে স্তব্ধ করে দিল।
যারা খেলা দেখছিল তারাও কৌতূহলী হয়ে পিছনে তাকিয়ে কোলাহলের কারণ আবিষ্কার করতে সচেষ্ট হল। আচম্বিতে জনতার এক বৃহৎ অংশ সবেগে আলোড়িত হয়ে এদিক ওদিক ছিটকে পড়ল। পরক্ষণেই সকলকে সতর্ক ও সন্ত্রস্ত করে জাগল বহুকণ্ঠের চিৎকার–
সাবধান! সাবধান! সরে যাও। ক্ষিপ্ত অশ্ব ছুটে আসছে! ঝটিকার আকস্মিক আবির্ভাবে
গাছের তলায় ঝরা পাতার রাশি যেমন উড়ে যায়, ঠিক তেমনি ভাবেই রাজপথের উপর দিয়ে সবেগে অদৃশ্য হয়ে গেল পথচারীদের ধাবমান মূর্তি।
কিশোর সচমকে দেখল তার আশেপাশে গেরুয়াধারী ছাড়া আর কেউ নেই। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই লোকারণ্যে আবৃত রাজপথ জনমানবশূন্য হয়ে গেছে।
বাঁচাও! বাঁচাও!
পথের বাঁক ঘুরে একটি বৃহৎ অট্টালিকার তলায় আত্মপ্রকাশ করল দ্রুতবেগে ধাবমান এক বিশাল অশ্ব। অশ্বের কণ্ঠ আলিঙ্গন করে তার পিঠের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে এক স্থূলকায় ব্যক্তি কোনোমতে নিজেকে রক্ষা করছে এবং পরিত্রাহি চিঙ্কারে সাহায্য চাইছে, বাঁচাও! বাঁচাও!