মহারাজ! মহাসত্ত্ব বললেন, আপনি যে গুপ্তধনের কথা বলেছিলেন, তার সন্ধান নিশ্চয়ই শশক আপনাকে জানিয়েছে?
–হ্যাঁ। আমি দুই-এক দিনের মধ্যেই এক সেনাদল নিয়ে ওই গুপ্তধন উদ্ধার করব।
–সেনাদল। কেন? ওই স্থান তো আপনার পরম সুহৃদ অনার্যরাজ মুলকের অধিকারভুক্ত।
যুদ্ধের জন্য নয়; গুহামুখ থেকে প্রস্তররাশিকে অপসারিত করার জন্যই সৈন্যদলের প্রয়োজন। ওই অর্থ দিয়ে রাজ্যের উন্নতিসাধন করা যাবে।
হু, তাহলে রাজ্যের সংবাদ একরকম ভালই, মহাসত্ত্ব বললেন, তবে দস্যু পরন্তপের মৃত্যুসংবাদ পেলে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হতে পারতাম।
পরন্তপের মৃত্যুতে আপনি খুশি হতে পারেন, রুদ্রদমন বললেন, কিন্তু শশক আশা করে বন্ধুবর পরন্তপ ওই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়েছে।
–বন্ধুবর পরন্তপ! মহারাজ, আপনি রসিকতা করেও দস্যু পরন্তপকে বন্ধু বলে অভিহিত করবেন না।
–শশকের বন্ধু বলেই বন্ধুবর বিশেষণে ভূষিত করেছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে পরন্তপকে বন্ধু বলে স্বীকার করিনি।
দস্যু পরন্তপ শশকের বন্ধু! মহারাজ! এ আপনি কি বলছেন!
ঠিকই বলছি, রুদ্রদমন বললেন, শশকের সঙ্গে পরন্তপের বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়েছিল। রাজা রুদ্রদমনের ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ নিয়ে মতান্তর উপস্থিত না হলে গুহামধ্যে আবিষ্কৃত গুপ্তধনের কিয়দংশ গ্রহণ করে পরন্তপ স্বচ্ছন্দে সীমানা অতিক্রম করে পার্শ্ববর্তী রাজ্যে গমন করতে পারত। অবশ্য ভূমিকম্পের ব্যাপারটা স্বতন্ত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিণাম নিয়ে কোনো কথা বলা চলে না।
মহাসত্ত্ব বললেন, আপনি বলছেন ভূমিকম্পের কবল থেকে পরন্তপ যদি আত্মরক্ষা করতে পারত এবং মহারাজের প্রসঙ্গ নিয়ে যদি শশকের সঙ্গে তার মতভেদ না ঘটত, তাহলে সীমানা অতিক্রম করে পার্শ্ববর্তী রাজ্যে গমন করতে তার অসুবিধা ছিল না? শশক তাকে গুপ্তধনের কিছু অংশ আত্মসাৎ করে প্রস্থান করতে বাধা দিত না?
রুদ্রদমন বললেন, কেন বাধা দেবে? গুপ্তধনের সন্ধান তো পরন্তপই দিয়েছিল। শশকের ধারণা, দস্য হলেও পরন্তপ খুব খারাপ লোক নয়। সুতরাং শ্রাবস্তী রাজ্যে উৎপাত না করে সে যদি গুপ্তধন থেকে তার ন্যায্য অংশ নিয়ে দেশান্তরী হত, তাহলে শশক নিশ্চয়ই আনন্দলাভ করত। শশক মনে করে পরন্তপের মতো মানুষকে সত্তাবে জীবনযাপনের একটা সুযোগ দেওয়া উচিত।
মহাসত্ত্ব এমন আশ্চর্য হয়ে গেলেন যে, কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। মহারাজ রুদ্রদমন পুনরায় গভীর অভিনিবেশ সহকারে নিজের মুখমণ্ডল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। ক্ষপণকের সাহায্যে না নিয়ে নিবিড় শ্মশ্রুরাশিকে স্বহস্তে নির্মূল করে সম্ভবত আত্মপ্রসাদ উপভোগ করছিলেন তিনি।
মন্ত্রী মহাসত্ত্ব হঠাৎ কণ্ঠ মধ্যে একটি অস্ফুট শব্দ করলেন, তারপর বললেন, মহারাজ!
দর্পণ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মহাসত্ত্বের দিকে জিজ্ঞাসু চক্ষে তাকালেন রুদ্রদমন।
–মহারাজ! আম্রপালী থেকে রাজদূত এসেছিলেন।
দূতের আগমন সংবাদ জানিয়েই আবার নীরব হলেন মহাসত্ত্ব।
রুদ্রদমন একটু আশ্চর্য হয়ে বললেন, আম্রপালীর রাজদূত! হঠাৎ!… কি সংবাদ?
মহাসত্ত্ব বললেন, আম্রপালী রাজ্যে রাজকন্যার স্বয়ংবর সভা বসছে আগামী ফাল্গুন মাসের সাত তারিখে। সেই সংবাদ দিতে এসেছিলেন রাজদূত।
রুদ্রদমন হঠাৎ আবিষ্কার করলেন তাঁর ক্ষুর এবং দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে কয়েকটি অবাঞ্ছিত কেশ মুখের একপাশে এখনও অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। তাড়াতাড়ি ক্ষুর উদ্যত করে তিনি মুখের সংস্কার-সাধনে তৎপর হলেন।
মহাসত্ত্ব বললেন, মহারাজ রাজ্যে অনুপস্থিত শুনে দূত মহাশয় বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু নিমন্ত্রণলিপি দিয়ে বলে গেছেন, মহারাজ রুদ্রদমন যদি স্বয়ংবর শুরু হওয়ার আগে রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন, তবে তিনি যেন অনুগ্রহপূর্বক স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত থেকে আম্রপালী রাজ্যকে কৃতার্থ করেন।
রুদ্রদমন সম্পূর্ণ নীরব। মুখমণ্ডলে শারাশিকে নির্মূল করার পরেও যে দুই একটি অবাঞ্ছিত কেশ মহারাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, পুনর্বার ক্ষুরের স্পর্শে এখন তারাও বিলুপ্ত; এখন, গুম্ফটিকে আরও সূক্ষ্ম করলে ফলাফল সন্তোষজনক হতে পারে কিনা সেই চিন্তাতেই মগ্ন হয়ে গেছেন রুদ্রদমন।
কণ্ঠ মধ্যে ঘুৎকারধ্বনির ন্যায় একটি শব্দ করে মহাসত্ত্ব বললেন, স্বয়ংবর সভা শুরু হতে এখনো প্রায় দশ দিন বিলম্ব আছে। আম্রপালীর রাজকন্যার রূপের খ্যাতি
বাধা দিয়ে রুদ্রদমন বলে উঠলেন, মন্ত্রীবর! পথশ্রমে আমার শরীর এত ক্লান্ত যে, একাদিক্রমে অন্তত একমাস সম্পূর্ণ বিশ্রামের প্রয়োজন। এখনই নিদ্রায় অভিভূত হয়ে পড়েছি, আর দাঁড়াতে পারছি না। এখন শয্যাগ্রহণ করতে চললাম।
মহাসত্ত্বের দিকে একবারও দৃষ্টিপাত না করে প্রাসাদের মধ্যে অন্তর্ধান করলেন রুদ্রদমন। তার গমনপথের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মন্ত্রী মহাসত্ত্ব।