সন্তুষ্ট হয়ে মহারাজ হৃষ্টস্বরে বললেন, ভালোই হয়েছে; তবে শশক নামে কোনো পেশাদার ভ্রাম্যমাণ যোদ্ধা মন্ত্রীবরকে তার অনুরোধ জানাতে পারে। কিন্তু শ্রাবস্তী রাজ্যের মন্ত্রীকে উক্ত ব্যক্তি নির্দেশ দেবে এমন ধৃষ্টতার প্রকাশ আমি কল্পনা করতে পারি না। মন্ত্রী মহাসত্ত্বের ওষ্ঠাধরে ক্ষীণ হাসি প্রশস্ত হল। মহারাজ আবার বললেন, মন্ত্রীবর! কর্ণদেব নামে ওই কিশোরের যোগ্যতা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত থাকুন। সীমান্তবাহিনীতে রক্ষীদলের মধ্যে তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরাস্ত করতে পারে এমন ক্ষমতা কোনো রক্ষীর আছে কিনা সন্দেহ।
মহাসত্ত্বের ললাটে জাগল মৃদু কুঞ্চনরেখা, মহারাজের কথার প্রতিবাদ করা উচিত নয়। তবু বলছি, এটা যেন অতিশয়োক্তি মনে হচ্ছে।
রুদ্রদমন হাসলেন, মন্ত্রীবর!জল্লাদ নামে এক কুখ্যাত দস্যু তার দুই সঙ্গীকে নিয়ে কর্ণদেবকে আক্রমণ করেছিল। যুদ্ধের ফলে জল্লাদ ও তার দুই সঙ্গী প্রাণ হারিয়েছে কর্ণদেব নামক ওই কিশোরের অসির আঘাতে। আরও একটা কথা মনে রাখবেন– কিশোর কর্ণদেব ছিল দস্যু পরন্তপের সর্বপেক্ষা বিশ্বস্ত অনুচর।
মহামন্ত্রী সচমকে বলে উঠলেন, ওই কিশোর দস্যু পরন্তপের বিশ্বস্ত অনুচর! কি আশ্চর্য মহারাজ, আপনি সকল তথ্য অবগত হয়েও তাকে সীমান্ত বাহিনীতে নিযুক্ত করার ব্যবস্থা করলেন? ওই বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত রক্ষী ইচ্ছা করলে গুপ্তশত্রুর নিকট হতে উৎকোচ গ্রহণ করতে পারে অথবা অর্থলোভে অন্তর্ঘাতমূলক কার্যে ব্যাপৃত হয়
বাধা দিয়ে মহারাজ বললেন, আবার আপনি ভুল করলেন। মন্ত্রীবর। কর্ণদেবকে সীমান্তবাহিনীতে নিযুক্ত করার অনুরোধ এসেছে শশকের কাছ থেকে এবং সেই অনুরোধ রক্ষা করেছেন আপনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই ঘটনার সঙ্গে আদৌ জড়িত নই। তবে এটুকু বলতে পারি-~শশকের পরামর্শে কাজ করলে রাজ্যের অমঙ্গল হবে না।
গম্ভীর কণ্ঠে মহাসত্ত বললেন, শশকের অনরোধ আমার কাছে মহারাজ রুদ্রদমনের আদেশের সমতুল্য।… হ্যাঁ, একটি প্রশ্নের উত্তর আমি আপনার কাছে পাইনি। মনে হয়, ওই প্রশ্নটি মহারাজকে বিব্রত করেছে। তবু এই রাজ্যের গুরুদায়িত্ব আমার স্কন্ধে রয়েছে বলেই শ্রাবন্তীর মঙ্গলের জন্য উক্ত প্রশ্নটি আবার আপনার সম্মুখে উপস্থিত করছি। আশা করি আপনি বিব্রত বা ক্রুদ্ধ হবেন না।
–আমার ক্রোধের ভয়ে মহামন্ত্রীকে কোনোদিন বিচলিত দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না। মন্ত্রীবর! অনর্থক কালক্ষেপ না করে আপনার বক্তব্য উপস্থিত করুন।
দস্যু পরন্তপের কি সংবাদ? আপনার পরম সুহৃদ শশক আশা করি নিরুদ্দিষ্ট পরন্তপের সন্ধান পেয়েছে?
-হ্যাঁ।
–সে কোথায়?
–বলতে পারি না।
–মহারাজ! আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না। শশক নাকি পলাতক পরন্তপের সন্ধান পেয়েছে, অথচ আপনি জানেন না ওই দস্যু এখন কোথায়! এ কি হেঁয়ালি!
মন্ত্রীবর! মহারাজ বললেন, সম্প্রতি ভূমিকম্পের ফলে রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত একটি পর্বত ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। ব্যাদিতবদন কঙ্কালমুণ্ডের ন্যায় ওই পর্বতের সানুদেশে যে প্রকাণ্ড গুহাগহ্বর আছে, সেই গুহামুখ ভীষণ ভূমিকম্পের ফলে রাশি রাশি প্রস্তরে আবৃত হয়েছে। ওই গিরিগুহার ভিতর
বাধা দিয়ে মহাসত্ত্ব অসহিষ্ণু ভাবে বললেন, মহারাজ! আপনার কথায় বাধা দিয়ে অমার্জনীয় ধৃষ্টতা প্রকাশ করলাম, তবু নিজগুণে ক্ষমা করবেন। প্রাকৃতিক বিপর্যয় সম্পর্কে এই মুহূর্তে আমি আলোচনা করতে চাই নি, আমি চেয়েছিলাম
–আপনি যে দস্যু পরন্তপের সন্ধান জানতে চাইছেন সে বিষয়ে আমি অবগত। অনুগ্রহ করে আমার বক্তব্য শেষ করতে দিন। যা বলছিলাম- ওই গিরিগুহার ভিতর গুপ্তধন আবিষ্কার করার পর দস্যু পরন্তপ ও আমার বন্ধু শশকের মধ্যে মহারাজ রুদ্রদমন সম্পর্কে কিছু আলোচনা হয়। আলোচনার ফলে উত্তেজিত হয়ে দুজনেই যখন গুহার বাইরে আসে, তখন হঠাৎ ভূমিকম্প শুরু হয়। ভূমিকম্পের প্রচণ্ড তাড়নায় চারদিকে রাশি রাশি প্রস্তর নিক্ষিপ্ত হতে থাকে এবং পর্বতশিখরের কিয়দংশ চূর্ণবিচুর্ণ হয়ে যায়। ওই প্রাকৃতিক বিপ্লবের মধ্যে শশক আর পরন্তপ পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সেইসময় নিকটেই দণ্ডায়মান কর্ণদেব নামে কিশোরটি হঠাৎ একটি প্রস্তরের আঘাতে মস্তকে আহত হয়ে জ্ঞান হারায় এবং শশক তাকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থানে এনে শুশ্রূষা করতে সচেষ্ট হয়। ভূমিকম্পের পরে পরন্তপের কোনো সন্ধান পায় নি শশক। সুতরাং বুঝতেই পারছেন যে, ওই দস্যু এখন কোথায় অবস্থান করছে আমার পক্ষে তা বলা সম্ভব নয়। পর্বতের তলদেশে রাশি রাশি প্রস্তর ও ভূমিকম্পে বিদীর্ণ গিরিপথের ফাটলে ফাটলে পরন্তপের মৃতদেহ সন্ধান করেছিল শশক ও কর্ণদেব কিন্তু দস্যর কোনো সন্ধান পাওয়া। যায়নি। তবে পর্বতের পাদমূলে রাশি রাশি প্রস্তরের স্তূপে সমাহিত একটি মানবদেহের সন্ধান পাওয়া খুবই কঠিন। হয়তো প্রস্তরস্তূপের মধ্যেই লুক্কায়িত রয়েছে দস্যর মৃতদেহ, আর না হয়তো সে ভুমিকম্পের সময়ে সকলের অজ্ঞাতসারে স্থানত্যাগ করেছে। তবে এই মুহূর্তে পরন্তপকে নিয়ে আমি বিশেষ বিব্রত বোধ করছি না। যদি সে বেঁচেও থাকে, বেশ কিছুদিনের মধ্যে সে আর দস্যুবৃত্তি করতে ইচ্ছুক হবে না।