শত্রুর মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করেই স্তব্ধ হয়ে গেল পরন্তপ শশকের ওষ্ঠাধরে ভয়াবহ হাসি, চক্ষে আহত শার্দুলের ক্রুদ্ধ জিঘাংসা!
স্তম্ভিত বিস্ময়ে কর্ণদেব দেখল অগ্নিকুণ্ডের আলোকে জীবন্ত তড়িৎশিখার মতো জ্বলে জ্বলে উঠল শশকের তরবার সামনে, পিছনে, দক্ষিণে, বামে প্রতিদ্বন্দ্বীর অসিতে প্রতিহত হয়ে ঝনৎকার তুলল বারংবার সেই তীব্র আক্রমণের ঝড়ে বিপর্যস্ত বিহ্বল পরন্তপ পিছিয়ে গেল দ্রুতপদে!
এই প্রথম পরন্তপের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছায়া দেখতে পেল কৰ্ণদেব!
ক্রমাগত পশ্চাৎপদ হতে হতে গুহার মুখে এসে পড়ল পরন্তপ, তারপর হঠাৎ এক প্রচণ্ড লক্ষে গুহার বাইরে এসে দাঁড়াল।
তৎক্ষণাৎ উদ্যত তরবারি হাতে ঝড়ের বেগে গুহার প্রবেশপথে লঙ্ঘন করল শশক। গুহার ভিতর থেকে প্রতিদ্বন্দ্বীদের আর দেখতে পেল না কর্ণদেব কেবল কানে ভেসে এল। সংঘাতমুখরিত অসির ঝনৎকার!
একমুহূর্ত নিশ্চল থেকে তাড়াতাড়ি শব্দ লক্ষ্য করে ছুটল কর্ণদেব। গুহার মুখে দাঁড়াতেই মুহূর্তের জন্য দ্বৈরথ-রণে ব্যাপৃত দুই যোদ্ধার দেহ তার দৃষ্টিগোচর হল, পরমুহূর্তেই তার পায়ের তুলায় দুলে উঠল পৃথিবী এবং ভারসাম্য হারিয়ে সে লম্বমান হল ভূমির উপর সঙ্গে সঙ্গে তার শ্রবণেন্দ্রিয়কে প্রায় বধির করে জাগল এক ভয়ংকর শব্দ, তারপরই মাথায় প্রচণ্ড আঘাত।
মুহূর্তের জন্য কর্ণদেব অনুভব করল তার দেহকে বেষ্টন করছে দুটি বলিষ্ঠ বাহু, পরক্ষণেই তার চেতনাকে লুপ্ত করে নামল মূৰ্ছার অন্ধকার…
২০. রাজা ও মন্ত্রী
মন্ত্রী মহাসত্ত্ব বললেন, মহারাজ! যদি অনুমতি দেন, তবে কয়েকটা প্রশ্ন করি।
দর্পণের সম্মুখে দাঁড়িয়ে একটি ক্ষুর হাতে গভীর মনোযোগের সঙ্গে মহারাজ রুদ্রদমন স্বহস্তে মুণ্ডিত মুখমণ্ডল পরিদর্শন করছিলেন, মহাসত্ত্বের কথার উত্তরে বললেন, মন্ত্রীবর! আমি বোধহয় একবারও নিজেকে অসুস্থ বলে ঘোষণা করিনি, অথবা আপনার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে অনিচ্ছা বা অক্ষমতাও প্রকাশ করিনি।
মহাসত্ত্বের ভ্রু কুঞ্চিত হল, মহারাজ! আপনি গভীর রাত্রে প্রাসাদে প্রবেশ করেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই আপনাকে শ্রান্ত ক্লান্ত মনে করেছিলাম। অতএব আজ রাত্রে আপনাকে উপযুক্ত বিশ্রামের সুযোগ দিয়ে কাল প্রভাতেই প্রয়োজনীয় বিষয়ের আলোচনা করব মনস্থ করেছিলাম। কিন্তু দেখলাম, মুহূর্ত মাত্র বিশ্রাম না করেই শ্মশ্রুরাশিকে মুখমণ্ডল থেকে বিলুপ্ত করতে আপনি বদ্ধপরিকর। তখন ভাবলাম, সম্ভবত আপনি বিশেষ ক্লান্ত নন, ক্ষৌরকর্ম শেষ হলে হয়তো কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিতে আপনি বিরক্তিবোধ করবেন না।
মহারাজ নিবিষ্টচিত্তে মুখগুল পরিদর্শন করছিলেন, দর্পণের মধ্যে প্রতিবিম্বের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই বললেন, মন্ত্রীবর! আমি বিরক্তিবোধ করলেই যে আপনি প্রশ্নবাণ নিক্ষেপে বিরত হবেন এমন তো মনে হয় না।
—সে-কি মহারাজ! আপনি বিরক্তিবোধ করলে আমি কি আপনাকে কোনো প্রশ্ন করতে পারি?
–পারেন। অন্তত কিছুদিন আগেও পেরেছিলেন। কিন্তু অতীতের উদাহরণ দিয়ে বর্তমানকে ভারাক্রান্ত করতে চাই না। অনুগ্রহপূর্বক আপনার বক্তব্য প্রকাশ করুন।
আপনার অবর্তমানে রাজ্যে কিছু কিছু বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে রাজ্যত্যাগ করে দীর্ঘকাল নিরুদ্দেশ হওয়া রাজ্যের পক্ষে নিরাপদ নয়।
-মন্ত্রী মহাসত্ত্ব থাকতে রাজ্য সম্পর্কে আমার কিছুমাত্র দুশ্চিন্তা নেই। আপনার পরবর্তী বক্তব্যের প্রসঙ্গ ধরে বলছি, প্রজার সম্পর্কে রাজার কিছু কর্তব্য ও দায়িত্ব আছে মনে করি বলেই মাঝে মাঝে আমাকে নিরুদ্দেশ হতে হয়।
-আপনার দায়িত্ববোধ সম্পর্কে কিছু বলার ধৃষ্টতা আমার নেই, তবে দায়িত্ব পালনের পদ্ধতি সম্পর্কে আপনার সঙ্গে আমার মতভেদ আছে। ছদ্মবেশে রাজ্য মধ্যে বিচরণ করে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা আদৌ নিরাপদ নয়।… ভালো কথা, পরন্তপের কোনো সংবাদ পেয়েছেন?
মন্ত্রী মহাসত্ত্বের কথার উত্তর না দিয়ে মহারাজ জিজ্ঞাসা করলেন, মন্ত্রীবর! আপনার কাছে কর্ণদেব নামে জনৈক কিশোরের একটি লিপি নিয়ে আসার কথা ছিল। সে এসেছে কি?
হ্যাঁ, এসেছিল, মহাসত্ত্ব বললেন, উক্ত লিপির নির্দেশ অনুসারে পূর্ব সীমান্তের রক্ষীবাহিনীর অধিনায়ক বিষাণ বর্মার নিকট তাকে প্রেরণ করেছি। কিন্তু মহারাজ
-বলুন।
ওই সুকুমার-দর্শন কিশোরের পক্ষে সীমান্তের রক্ষীবাহিনীতে যোগ দেওয়া আত্মহত্যারই নামান্তর মনে হয়। অন্তর্ঘাতী কার্যকলাপে নিযুক্ত গুপ্তশত্রু, অথবা শত্রুভাবাপন্ন ভয়ংকর অনার্য বাহিনীর চকিত আক্রমণের সম্মুখীন হলে ওই কিশোরের মৃত্যু অনিবার্য। সীমান্তবাহিনীতে যোগদানে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে যেভাবে কঠিন পরীক্ষার ভিতর দিয়ে যোগ্যতার পরিচয় দিতে হয়, এই ক্ষেত্রে সেইভাবে পরীক্ষাও করা হল না– কারণ, পত্রে লিখিত ছিল কোনো পরীক্ষা না করেই অবিলম্বে যেন তাকে সীমান্তের রক্ষিবাহিনীতে নিযুক্ত করা হয়। আপনার নির্দেশ অনুসারে তাকে বিষান বর্মার নিকট
বাধা দিয়ে মহারাজ রুদ্ৰদমন বলে উঠলেন, আমার নির্দেশ? অপনি কি বলছেন মন্ত্রিবর?
বিমূঢ় দৃষ্টিতে মহারাজের মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন মহাসত্ত্ব, তারপরই তার অধর-ওষ্ঠে ক্ষীণ হাসিররেখা দেখা দিল, না, আপনার নির্দেশ নয়- শশক নামে এক ভ্রাম্যমাণ পেশাদার যোদ্ধার নির্দেশ অনুসারে তাকে বিষান বর্মার নিকট প্রেরণ করেছি। তিনদিন পুর্বে সংবাদ পেয়েছি তাকে পূর্বদিকের সীমান্তবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।