কিশোর কথা বলল না; দণ্ডায়মান মল্পের পেশীবহুল দেহের বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে লাগল তার দুই চোখের তীব্র দৃষ্টি।
জয়দ্রথ বিরক্ত হল, কি দেখছ?
–তোমাকে।
-হ্যাঁ, আমার দেহ যে দেখার মতো সেকথা আমিও জানি। কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার চেহারা দেখলে দর্শনী দিতে হবে। তবে তোমাদের হাত তো ভালোভাবে উপুড় হয় না, তাই বলছি পথ ছাড়ো।
কিশোরের মুখে মৃদু হাসির রেখা দেখা দিল, তুমি শক্তিমান?
–সন্দেহ আছে?
–না। কিন্তু তুমি এইমাত্র বলছিলে জয়দ্রথ তার অসীম শক্তির পরিচয় দিচ্ছে। অসীম কথাটা অস্পষ্ট। আমি স্পষ্ট কথা ভালোবাসি। আমি তোমার শক্তির সঠিক পরিমাপ দেখতে চাই।
-তাতে আমার লাভ?
–যদি সত্যিই অসাধারণ শক্তির অধিকারী হও তাহলে লাভ আছে। দেখি তোমার হাত?
বিস্মিত হয়ে জয়দ্রথ হাত এগিয়ে দিল। উর্ধ্বাঙ্গে পরিহিত আঙরাখার ভিতর হাত ঢুকিয়ে কি যেন বার করল কিশোর, তারপর সেই বস্তুটি সমর্পণ করল জয়দ্রথের হাতে– এতে চলবে?
বস্তুটির দিকে তাকিয়ে জয়দ্রথের চক্ষুস্থির। এ কি! এ যে—
বাধা দিয়ে কিশোর বলল, ওটা তোমার। এখন খেলা দেখাও। নাকি, আপত্তি আছে?
–বিলক্ষণ! মূল্য যখন পেয়েছি তখন খেলা দেখাতে আপত্তি করব কেন?
–তাহলে দেখাও।
পথের একপাশে দণ্ডায়মান যে ক্ষুদ্রকার শকটের কথা পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে, তার দিকে এগিয়ে গেল জয়দ্ৰথ। শকটের ওপর বিস্তৃত রঙিন কাপড়টি তুলে নিতেই ভিতরের বস্তুগুলি দর্শকদের দৃষ্টিগোচর হল– কয়েকটি লৌহগোলক, দড়ির স্তূপ, প্রকাণ্ড এক সিন্দুক এবং আরও বিভিন্ন ধরনের বস্তু।
সিন্দুকের দুইপাশে লোহার আংটা বসানো। আংটা ধরে সিন্দুকটিকে মাটিতে রেখে জয়দ্রথ বুক ফুলিয়ে দাঁড়াল।
শুনুন, জয়দ্রথ হাঁক দিল, আপনাদের মধ্যে যদি কোনো ব্যক্তি এই সিন্দুক মাটি থেকে একহাত উপরে তুলতে পারেন, তবে আমি এইখানে সাত হাত নাকখৎ দেব।
চার-পাঁচ জন বলিষ্ঠ ব্যক্তি জনতার ভিতর থেকে এগিয়ে গেল সিন্দুকের দিকে।
প্রত্যেকেরই চেষ্টা বিফল হল। একহাত তো দূরের কথা, সিন্দুক ভূমিশয্যা ছেড়ে এক আঙুল উপরেও উঠল না। একজন বলিষ্ঠ-দর্শন পুরুষ প্রাণপণ চেষ্টার ফলে সিন্দুক আর ভূমির মধ্যে সামান্য একটু ফাঁক সৃষ্টি করেছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য তারপরই সিন্দুক আবার নেমে এসে মাটি কামড়ে ধরল অনড় হয়ে।
বাহুতে সশব্দে চপেটাঘাত করে হেসে উঠল জয়দ্ৰথ, ওটিকে সিন্দুক বলে ভ্রম করবেন না। সিন্দুকের আকারে নির্মিত হলেও বস্তুটি একেবারে নিরেট।
উপস্থিত জনমণ্ডলীর ওপর একবার দৃষ্টিকে সঞ্চালিত করে জয়দ্রথ এগিয়ে গিয়ে সিন্দুকের দুপাশে আংটা চেপে ধরল, দেখুন, এই গুরুভার বস্তু আমি মাথার উপর তুলব।
জনতা রুদ্ধশ্বাসে দেখতে লাগল। জয়দ্রথের কাধ ও বাহুর মাংসপেশী ফলে ফলে উঠল ধীরে, অতি ধীরে শুন্যে উঠতে লাগল সেই নিরেট সিন্দুক এবং একটু পরেই তার মাথার ওপর দুই প্রসারিত বাহুর দৃঢ়মুষ্টির মধ্যে অবস্থান করতে লাগল।
সেই অবস্থাতেই কিশোরকে সম্বোধন করে জয়দ্রথ বলল, কিশোর, তুমি কি সন্তুষ্ট হয়েছ?
-হয়েছি। তবে আমি আরও কিছু দেখতে চাই।
–নিশ্চয়। একটু অপেক্ষা করো।
সিন্দুকটিকে নিয়ে জয়দ্রথ শকটের মধ্যে রাখল। তারপর সেখান থেকে টেনে নিল একটি স্কুল লৌহদণ্ড।
দণ্ডটিকে আন্দোলিত করে জয়দ্রথ বলল, মহাশয়গণ। আমাকে একটু সময় দিন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করেই আমার অসাধারণ শক্তির আর একটি উদাহরণ আপনাদের সামনে উপস্থিত করব।
যারা সিন্দুক নিয়ে টানাটানি করে গলদঘর্ম হয়েছিল, তাদের মধ্যে এক ব্যক্তি কিশোরের পাশে দাঁড়িয়েছিল। সে বলে উঠল, আমি খুব দুর্বল মানুষ নই! প্রত্যহ ব্যায়াম করি। কিন্তু ওই সিন্দুক তুলতে গিয়ে বুঝলাম অমানুষিক শক্তির অধিকারী না হলে ওই গুরুভার বস্তুকে মাথার ওপর উত্তোলন করা সম্ভব নয়।
কিশোর বলল, মনে হয় ওই বস্তুটির ওজন খুব কম করেও তিন মণ হবে। জয়দ্রথ যে অসাধারণ শক্তির অধিকারী সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
পিছন থেকে মৃদু-গম্ভীর স্বরে একটি মন্তব্য ভেসে এল কিশোরের কানে, ভার উত্তোলনই শক্তির একমাত্র পরিচয় নয়।
সচমকে ফিরে কিশোর দেখল তার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে মুণ্ডিতমস্তক এক বিপুল বপু গেরুয়াধারী পুরুষ।
কিশোর ভ্রূ কুঁচকে প্রশ্ন করল, কথাটা কি আপনি বললেন?
স্মিত হাস্যে উত্তর এল, হ্যাঁ।
বক্তার সর্বাঙ্গে একবার চোখ বুলিয়ে নিল কিশোর দক্ষিণ স্কন্ধের উপর থেকে বক্ষ বেষ্টন করে জানু পর্যন্ত নেমে এসে গেরুয়া কাপড় তার দেহকে আবৃত করেছে; আবরণের তলায় দেহের গঠন অদৃশ্য। শরীরের আয়তন প্রকাণ্ড হলেও কিশোরের মনে হল গেরুয়াধারীর দেহে পেশীর পরিবর্তে চর্বিরই আধিক্য ঘটেছে। তবে হ্যাঁ- গ্রীবা, স্কন্ধ ও বাহু কিছুটা শক্তিমত্তার পরিচয় বহন করছে বটে। কিন্তু জয়দ্রথের পেশী-স্ফীত বিশাল দেহের তুলনায় গেরুয়াধারীর দেহ একেবারেই নগণ্য।
গেরুয়াধারীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে নিল কিশোর। দেখুন, জয়দ্রথের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, এই লৌহদণ্ড আমি হাতের চাপে বাঁকা করব। আপনারা ইচ্ছে করলে এই দণ্ডের কাঠিন্য ও দৃঢ়তা পরীক্ষা করতে পারেন।
কিশোর আবার জয়দ্রথের দিকে ফিরল। গেরুয়াধারীর কথায় তার বিরক্তির সঞ্চার হয়েছিল, কিন্তু প্রতিবাদ না করে সে জয়দ্রথের দিকে মনোনিবেশ করল।