পরন্তপ রূঢ়স্বরে বলল, কর্ণদেব! মনে রেখো– আমি তোমাকে ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের গ্রাস থেকে রক্ষা করেছি। শ্রাবস্তীর আতঙ্ক দস্যু পরযুপের বিরুদ্ধাচরণ করতে আজ তুমি ভীত নও- কিন্তু কার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তোমার এত সাহস? কে তোমায় অস্ত্রচালনার শিক্ষা দিয়েছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর? কার শিক্ষার গুণে এক ভীরু বালক কৈশোরে পদার্পণ করে ব্যাঘ্রবৎ বিক্রমের অধিকারী?
তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল পরন্তপের উগ্র কণ্ঠ, কর্ণদেব! আজ আমার জন্যই তোমার এই রূপান্তর। মেষশাবক আজ আমারই শিক্ষার গুণে ব্যাঘশাবকে পরিণত- কিন্তু কর্ণদেব! আমার গুরুদক্ষিণা কোথায়?… নীরব কেন কর্ণদেব?… আচ্ছা, তুমি নীরব ও নিরপেক্ষ হয়ে অবস্থান করলেই আমার গুরুদক্ষিণা দেওয়া হবে। মহারাজ! প্রস্তুত হন, আমি আপনাকে আক্রমণ করছি।
পরন্তপ এক পা অগ্রসর হয়ে অসি উদ্যত করতেই শশক বলল, আমি রুদ্রদমন নই, আমি নিতান্তই শশক। পরন্তপ! অকারণ যুদ্ধে পরস্পরের প্রাণ বিপন্ন করার কি প্রয়োজন?
মহারাজ রুদ্রদমন! আপনার বাগজালে কিশোর কর্ণদেব বিভ্রান্ত হতে পারে, পরন্তপ বলল, কিন্তু আমি আপনার কথায় ভুলব না। দীর্ঘ এই পদযাত্রায় আপনার গতিবিধি আমি লক্ষ করেছি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এমন নির্ভীক রাজোচিত পদক্ষে, সিংহাবলোকনে দৃষ্টিপাত এবং উদ্ধত গ্রীবাভঙ্গির এমন অপূর্ব সমন্বয়ের অধিকারী হবে ছিদ্রান্বেষী এক গুপ্তচর?… অসম্ভব। আর অকারণ যুদ্ধের কথা যদি বলেন, তাহলে বলব কারণ-অকারণে বিচার নিতান্তই আপেক্ষিক একের বিচারে যেকর্ম অবশ্য করণীয়, অপরের বিচারে তা নিরর্থক।
ক্ষান্ত হও পরন্তপ, গম্ভীর স্বরে শশক বলল, আমি তোমাকে হত্যা করতে চাই না।
কিন্তু আমি আপনাকে হত্যা করতে চাই, পরন্তপের ওষ্ঠাধরে কঠিন হাসির রেখা, মহারাজ রুদ্রদমন আর দস্যু পরন্তপের একই রাজ্যে স্থান হতে পারে না। আমি এই রাজ্যেই বাস করতে চাই। অতএব, আপনাকে হত্যা করতে আমি সচেষ্ট হব। প্রস্তুত হন মহারাজ এই আমি আক্রমণ করলাম।
তরবারিকে অগ্রবর্তী করে আক্রমণ করল পরন্তপ বিদ্যুৎ শিখার ন্যায় ছুটে এল শাণিত অস্ত্র শশকের বক্ষ অভিমুখে! সঙ্গে সঙ্গে এক পায়ের উপর ভর দিয়ে ঘুরে গেল শশকের দেহ- ক্ষিপ্র আকর্ষণে কোষ হতে অর্ধ-উত্থিত তরবারিতে ঘর্ষিত হয়ে লক্ষ্যস্থল থেকে সরে গেল পরন্তপের অস্ত্র ব্যর্থ আক্রোশে শূন্যে দংশন করল শোণিত পিপাসায় অতৃপ্ত তরবার!
পরক্ষণেই শশকের কোষ থেকে অর্ধ-উত্থিত তরবারি সম্পূর্ণ বহির্গত হয়ে ঝলসে উঠল!
এমন ক্ষিপ্র আক্রমণ, আর এমন চকিত প্রতিরোধের ক্ষিপ্রতর সঞ্চালন আগে কখনও দেখে নি কর্ণদেব! বিস্ময়ে বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে সে দেখতে লাগল এক ভয়ংকর দ্বৈরথ যুদ্ধ!
অগ্নিকুণ্ডের রক্তিম আলোতে বিদ্যুৎবর্ষণ করে সশব্দ সংঘাতে পরস্পরকে বারংবার আলিঙ্গন করল দুটি ঘূর্ণিত তরবারি তবু যুযুধানদের অস্ত্রের ফলকে পড়ল না রক্তের রেখা, ব্যর্থ আক্রোশে ঘুরতে লাগল দুটি শাণিত তরবারি হিংস্র আক্রোশে বিকশিত শ্বাপদ-দন্তেরমতো!….
পরন্তপের কাছে শিক্ষাগ্রহণ করার সময়ে বহুদিন তার অস্ত্রচালনার কৌশল দেখেছে কর্ণদেব, একাধিকবার তাকে ব্যাপৃত হতে দেখেছে দ্বন্দ্বযুদ্ধে কিন্তু আজকের লড়াই দেখে সে বুঝল অস্ত্রগুরুর আশ্চর্য দক্ষতার পরিচয় সে আগে কখনও পায় নি! প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রচণ্ড আক্রমণকে অপূর্ব কৌশলে বার বার বিফল করে দিচ্ছে পরন্তপ!
নিজের ক্ষমতার উপর কর্ণদেবের আস্থা ছিল, ক্রমে ক্রমে সেই আস্থার উপর অহঙ্কারের প্রলেপ পড়েছিল, ধারণা হয়েছিল অসিযুদ্ধে আজ তার ক্ষমতা বুঝি গুরুর চাইতেও বেশি কিন্তু আজ সে বুঝল পরন্তপের কাছে সে নিতান্ত শিশু মাত্র!
ব্যাঘ্রের ন্যায় ক্ষিপ্র এবং হস্তীর ন্যায় বলশালী শত্রুর আক্রমণ এড়িয়ে বারংবার প্রতি আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ছে পরন্তপ! অপরপক্ষ কম নয়- দুই-দুইবার পরন্তপের ভয়ংকর আঘাত ব্যর্থ করে দিল শশক, তরবারির ক্ষিপ্র সঞ্চালনে…
আচম্বিতে দুটি তরবারির হাতল প্রচণ্ড সংঘাতে মিলিত হল। পরন্তপ তাড়াতাড়ি নিজের তরবারি টেনে নেওয়ার চেষ্টা করল। পারল না। গুহার দেয়ালে তাকে সজোরে চেপে ধরে শশক বলে উঠল, পরন্তপ! আত্মসমর্পণ না করলে এইবার আর রক্ষা নেই। যদি বাঁচতে চাও, অস্ত্রত্যাগ করো।
পরন্তপের মুখ ঘর্মাক্ত হল। প্রচণ্ড পেষণে তার দেহ তখন গুহাগ্ৰাত্রে নিষ্পিষ্ট। শশক আবার বলল, আত্মসপৰ্মণ করো। পরন্তপ উত্তর দিল না। তার মুখের ভাব কঠিন হয়ে উঠল। শ্বাস-প্রশ্বাসের বেগ বর্ধিত হল…
হঠাৎ যে কি ঘটল বুঝতে পারল না কর্ণদেব– যোদ্ধাদের দেহ দুটি পাক খেযে ছিটকে গেল- পরক্ষণেই সে দেখল গুহার দেয়াল থেকে ছিটকে গুহার প্রায় মধ্যস্থলে এসে দাঁড়িয়ে ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী!
হা হা শব্দে হেসে উঠল পরন্তপ, মহারাজ! আমার ললাট বা বক্ষ শায়ক চিহ্ন গ্রহণ করতে রাজি নয়।
অকস্মাৎ পরন্তপের তরবারি শত্রুর দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়েই বিদ্যুচ্চমকের মতো বামদিকে সঞ্চালিত হল– মুহূর্তের মধ্যে রক্তাক্ত হয়ে উঠল শশকের দক্ষিণ জানু।
এতক্ষণে, অট্টহাস্য করে উঠল পরন্তপ, এতক্ষণে রাজরক্ত দর্শন করলাম।