কর্ণদেব বলল, গুপ্তচরবৃত্তি ভালো কি খারাপ সেটা নিয়ে আদৌ চিন্তা করছি না। আমি চিন্তিত হয়েছি আমাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে। বর্তমানে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তাতে মনে হয় তোমাকে হত্যা করতে পারলে আমরা নিরাপদ কিন্তু ওই চিন্তাকে কার্যে পরিণত করার প্রবৃত্তি হচ্ছে না।
শশক বলল, তোমাদের নিরাপত্তা আদৌ বিপন্ন নয়। মহারাজ রুদ্রদমনের কাছে আমি এমন বার্তা নিয়ে যাব না, যাতে তোমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে। এই ধনভাণ্ডার থেকে পরন্তপ যদি তার প্রাপ্য অংশ নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে অন্য রাজ্যে পলায়ন করে, তবে আমি তাকে বাধা দেব না। অতএব, নিরাপত্তা সম্পর্কে তোমাদের ভীত হওয়ার কারণ নেই।
–তুমি বাধা না দিলেও অনার্যসেনা আমাদের বন্দি করতে পারে।
-করবে না। বন্ধুবর পরন্তপের স্বপ্নবৃত্তান্ত শুনে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ ওই প্রহরীদের উপর আমার কিছু প্রভাব আছে। সুতরাং, মাভৈঃ!
পরন্তপ হেসে বলল, আমার কিশোর বন্ধু কর্ণদেব নিশ্চয়ই মহারাজের আশ্বাসবাক্যে আশ্বস্ত হয়ে নিরাপদ বোধ করছে। কিন্তু আমি পুরাতন পাপী, আমার মনোভাব ভিন্ন। এই বিপুল সম্পদের ভিতর থেকে আমাদের প্রাপ্য অংশ নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে কৌশাম্বী রাজ্যে পদার্পণ করা বর্তমানে আমাদের পক্ষে অসম্ভব। কারণ, আমাদের সঙ্গে অশ্ব নেই। কিছু অর্থ নিয়ে কৌশাম্বীতে গিয়ে সেখান থেকে অশ্ব ক্রয় করে এখানে আমরা ফিরে আসতে পারি, কিন্তু সেটা হবে পণ্ডশ্রম। ততক্ষণে এই সম্পত্তি যে মহারাজ রুদ্রদমনের অধিকারভুক্ত হবে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। তাছাড়া, বর্তমানে শশকের ছদ্মবেশে মহারাজ রুদ্রদমন আমাদের নিরাপদে দেশান্তরী হওয়ার সুযোগ দিলেও পরবর্তীকালে সীমান্ত অতিক্রম করে পুনরায় এইস্থানে প্রত্যাবর্তন করলে তিনি আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন বলে মনে হয় না। কি বলেন মহারাজ?
শশক বলল, মহারাজ রুদ্রদমন তার রাজ্যসীমার মধ্যে তোমার উপস্থিতি বাঞ্ছনীয় মনে করেন না, ভবিষ্যতেও করবেন না। কিন্তু তার অযোগ্য সেবক শশকের ধারণা পরন্তপের মতো মানুষ দস্যুবৃত্তি করলেও সে অনন্যসাধারণ ব্যক্তি– অতএব, উক্ত পরন্তপকে শ্রাবস্তীর বাইরে সভাবে জীবনযাপনের একটা সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। তাই পুনরায় প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনা ত্যাগ করে মূল্যবান কিছু রতন নিয়ে পরন্তপের কাল প্রত্যূষেই পলায়ন করা কর্তব্য। রত্নাদি বহন করার জন্য অশ্বের প্রয়োজন হবে না। কৌশাম্বী রাজ্যে গিয়ে ওই সকল রত্ন বিক্রয় করে যে অর্থ পাওয়া যাবে, তা দিয়ে একটি বা দুটি মানুষ নতুন ভাবে জীবন শুরু করতে পারে অনায়াসে। এই চিন্তা বোধহয় অনেক আগেই পরন্তপের মনে এসেছে, তাই কারও পরামর্শ ছাড়াই মূল্যবান কিছু রত্ন সে এর মধ্যেই হস্তগত করেছে। প্রত্যূষে পরন্তপের নিরাপদে সীমান্ত অতিক্রম করার ব্যবস্থা এই অধম করে দিতে পারবে বলেই মনে হয়।
ঊর্ধ্বাঙ্গ নত করে অভিবাদন জানিয়ে পরন্তপ বলল, মানুষ নিজের অবস্থায় সর্বদাই অসন্তুষ্ট। ক্ষুধার্ত ব্যক্তি অযাচিত ভাবে আহার্যের সন্ধান পেলেও সুখী হয় না, তৎক্ষণাৎ শয়নের ব্যবস্থা করার জন্য সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মানব-চরিত্রের ওই চিরন্তন দুর্বলতা থেকে আমিও মুক্ত নই। একটু আগেও বন্ধুবর শশক যা বলল, সেই রকম আমার পরিকল্পনাই ছিল। আর সেইজন্যই কয়েকটি মহার্ঘ রত্ন নিয়ে আমি প্রত্যূষে সকলের অজ্ঞাতসারে কর্ণদেবের সঙ্গে স্থান ত্যাগ করার সঙ্কল্প করেছিলাম। পরিবেশের এখন কিছু পরিবর্তন ঘটেছে, তাই বর্তমানে পূর্ব-সঙ্কল্প ত্যাগ করাই উচিত মনে করছি। শশকের যথার্থ পরিচয় শায়ন ও বল্লভের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হতো কি না সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই— তাদের অমতে তাদেরই সম্মুখে শশক অর্থাৎ মহারাজ সম্পর্কে স্বাধীন ভাবে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব হত না। সেইজন্যই কোনো কথা না বলে আমি স্থানত্যাগের পরিকল্পনা করেছিলাম। আকস্মিকভাবে ওই দুই ব্যক্তির মৃত্যু হওয়ায় পরিবেশ পরিবর্তিত; এবং আমিও পূর্বসঙ্কল্প ত্যাগ করে নতুন এক সিদ্ধান্তে উপস্থিত হয়েছি। ইহজীবনে বহু কুকর্ম করায় প্রাণান্তে নরকবাস আমার নিশ্চিত কিন্তু স্বর্গাধিপ ইন্দ্রের প্রিয়পাত্র মহারাজ রুদ্রদমনের হস্তে যুদ্ধে নিহত হলে নিশ্চয়ই স্বর্গে আরোহণের সুযোগ পাব। অতএব, মহারাজ! অসি নিষ্কাষিত করে আমাকে উদ্ধার করুন।
কথা শেষ করেই সশব্দে তরবারি কোষমুক্ত করল পরন্তপ। কর্ণদেব সবিস্ময়ে বলে উঠল, পরন্তপ। এই ব্যক্তি মহারাজ রুদ্রদমন অথবা গুপ্তচর শশক তা আমি জানি না। কিন্তু বিনা প্রয়োজনে তুমি যুদ্ধে লিপ্ত হতে চাইছ কেন? আমাদের যাত্রাপথ নির্বিঘ্ন, অনর্থক এই ব্যক্তির সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই।
পরন্তপ বলল, প্রয়োজন আছে কিনা সেটা আমি বুঝব। তুমি চুপ করো।
কর্ণদেব বলল, না। শশকের প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে আমি কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারি নি। কিন্তু এই ব্যক্তি আমাদের বন্ধুস্থানীয়। এই ভয়ঙ্কর যাত্রাপথে সে ছিল আমাদের অপরিহার্য সঙ্গী। আজ প্রয়োজন ফুরিয়েছে বলেই তাকে তুমি হত্যা করতে চাও?… না। আমি তোমাকে এমন অসঙ্গত কাজ করতে দেব না, পরন্তপ।