কর্ণদেব! হাতের উপরিভাগে কোনো বৈশিষ্ট্য তুমি দেখতে পাবে না, পরন্তপ বলল, কিন্তু বন্ধুবর শশক যদি করতল প্রসারিত করে, তাহলে আমার বিশ্বাস অঙ্গুরীয়তে কিছু বৈশিষ্ট্য তুমি আবিষ্কার করতে পারবে।
তাই নাকি? কর্ণদেব সবিস্ময়ে বলল, দেখি! দেখি! শশক স্থির হয়ে বসে রইল, হাত উলটিয়ে কর্ণদেবের কৌতূহল নিবারণের চেষ্টা করল না।
পরন্তপ বলল, উঁহু, বন্ধুবর তোমার সম্মুখে করতল প্রসারিত করতে রাজি হবে মনে হয় না। অঙ্গরীয়টি আদৌ সলোল বা সড়োল নয়, মধ্যস্থলের স্ফীত অংশটি সযত্নে ঘরিয়ে করতলে আবৃত আছে- পাছে তোমাদের দৃষ্টি ওদিকে পড়ে।
কর্ণদেব বলল, আমাদের দৃষ্টি পড়লে ক্ষতি কি? মধ্যস্থলের স্ফীত অংশটি ঢেকে রাখার চেষ্টাই বা কেন?
ক্ষতি আছে বৈকি, পরন্তপ বলল, মধ্যস্থলের স্ফীত অংশটি ঢেকে রাখার কারণ ঐখানেই খোদিত আছে শায়ক চিহ্ন।
শায়ক চিহ্ন! প্রায় চিৎকার করে উঠল কর্ণদেব, ওই চিহ্ন তো সাধারণ মানুষের ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। শায়ক চিহ্নই তো রাজশক্তির প্রতীক। শশক তাহলে সত্যই মহারাজ রুদ্রদমনের বিশ্বস্ত গুপ্তচর!
পরন্তপ বলল, তুমি নিতান্তই মূর্খ। তুমি দেখেছ শল্যের উদ্ধারপর্বে আর নেকড়েবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে এই ব্যক্তি অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেছে; দূর থেকে একাধিক অশ্বের বলগা বাণাঘাতে ছিন্ন করে এবং আক্রমণোদ্যত হস্তীর দুই চক্ষুকে অব্যর্থ সন্ধানে তিরবিদ্ধ করে অত্যাশ্চর্য ধনুর্বিদ্যার পরিচয় দিয়েছে– সর্বশেষে গুহাগাত্রে খোদিত আদ্য-অক্ষরের জটিল রহস্য ভেদ করে গুপ্তধন আবিষ্কার করেছে অনায়াসে। দেহে-মনে এমন অসাধারণ শক্তিধর উচ্চাভিলাষী না হয়ে গুপ্তচরের ঘৃণ্য ও তুচ্ছ বৃত্তি অবলম্বন করবে?… কর্ণদেব! তুমি নির্বোধ!… তোমার সম্মুখে শশক নামে অভিহিত মানুষটি হলেন মহারাজ রুদ্রদমন।
বিস্ময়-অভিভূত কণ্ঠে কর্ণদেব বলে উঠল, তুমি– আপনি, মহারাজ রুদ্রদমন?
মৃদুহাস্যে ওষ্ঠাধর রঞ্জিত করে শশক বলল, না, কর্ণদেব আমি মহারাজ রুদ্রদমন নই। আমার মতো সামান্য ব্যক্তিকে মহারাজ সম্বোধনে সম্মান প্রদর্শন করলে শ্রাবস্তীর অধিপতি মহারাজ রুদ্রদমনকে অপমান করা হয়। তাই রাজভক্ত প্রজার কর্তব্য অনুসারে প্রতিবাদ জানিয়ে বলছি- আমি শশক, মহারাজ রুদ্রদমন নই। যোদ্ধার ছদ্মবেশে ভ্রাম্যমাণ এক গুপ্তচর পরন্তপের শ্যেনদৃষ্টিতে ধরা পড়েছে একথা স্বীকার করলেই বন্ধুবর পরন্তপের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও বিশ্লেষণ শক্তিকে যথেষ্ট স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু গুপ্তচর শশককে ছদ্মবেশী মহারাজ মনে করলে বন্ধুবরের মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্পর্কে যে-কোনো ব্যক্তি সন্দেহ প্রকাশ করবে।
দ্বিধাজড়িত স্বরে কর্ণদেব বলল, শশক! স্বীকার করছ তুমি।
শশক বলল, আমি মহারাজের নিযুক্ত গুপ্তচর। পরন্তপের সন্ধানে বিচরণ করছি দেশের বিভিন্ন স্থানে। আমার বুদ্ধি, শক্তি ও অস্ত্রচালনার দক্ষতায় প্রশংসা করে পরন্তপ বলেছে আমার ন্যায় দেহে-মনে অসাধারণ শক্তির অধিকারী কোনো ব্যক্তি উচ্চাভিলাষী না হয়ে গুপ্তচরের তুচ্ছ বৃত্তিতে আত্মনিয়োগ করতে পারে না। বন্ধুবর পরন্তপের উক্ত মন্তব্যের বিরুদ্ধে বিনীত প্রতিবাদ জানিয়ে বলছি, উচ্চাভিলাষী বিশেষণটি নিতান্তই আপেক্ষিক। আমি ব্যক্তিগতভাবে গুপ্তচরবৃত্তিকে ঘৃণ্য বা তুচ্ছ মনে করি না। দেশের শুভঅশুভ জানার জন্যে এবং অন্তর্ঘাতী কার্যকলাপ রোধ করার জন্যে গুপ্তচরের প্রয়োজন আছে। বীরযোদ্ধাকে দেশের মানুষ শ্রদ্ধা করে দেশের কার্যে আত্মনিয়োগ করে যে যোদ্ধা নিহত হয়, সে সমগ্র দেশবাসীর শ্রদ্ধার পাত্র; কিন্তু যে গুপ্তচর দেশবাসীর কল্যাণের জন্য মৃত্যুবরণ করে, তার উদ্দেশে একটি সহানুভূতির বাক্য পর্যন্ত উচ্চারিত হয় না। অথচ লোকচক্ষুর অন্তরালে ওই গুপ্তচরবৃন্দ প্রতি মুহূর্তে প্রাণ বিপন্ন করছে দেশেরই কল্যাণ কামনায়। এই নীরব আত্মদান, এই নীরব দেশসেবা যদি ঘৃণ্য ও তুচ্ছ হয়, তাহলে মহৎ কার্য কাকে বলব?… না, কর্ণদেব! গুপ্তচরবৃত্তি ঘৃণ্য নয়, তুচ্ছ নয়। আমার সামান্য শক্তি দিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে আমি এইভাবেই দেশসেবা করে যাব– এই আমার অভিলাষ। এই অভিলাষকে যদি কেউ উচ্চ-অভিলাষ আখ্যা দিতে রাজি না হয়, তবে সেটা ব্যক্তিগত মতামতের ব্যাপার। কিন্তু রণক্ষেত্রে সহস্র মানুষের বাহবার সম্মুখে স্ফীতবক্ষ প্রশংসালুব্ধ কোনো উচ্চাভিলাষী বীরপুরুষের তুলনায় আমি নিজেকে কোনো অংশে হীন মনে করি না। গুপ্তচরবৃত্তির জন্য আমি লজ্জিত নই কিছুমাত্র। লজ্জা এই যে, আমার চাইতে অধিকতর বুদ্ধিমান এক ব্যক্তির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার প্রকৃত স্বরূপ ধরা পড়ে গেছে।
কর্ণদেব বিব্রতস্বরে বলল, শশক! তুমি যে গুপ্তচর একথা তাহলে সত্য। আমাদের অস্তিত্ব এখন বিপন্ন। তোমাকে হত্যা করাই এখন আমাদের কর্তব্য।
শশক হেসে বলল, যদি কোনো সীমান্তরক্ষী বা নগররক্ষী তোমাদের হাতে প্রাণ হারায়, তাহলে দেশের মানুষ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলবে দস্যুকে বন্দি করতে গিয়ে যে রক্ষী মৃত্যুবরণ করে, তার কর্তব্যবোধের তুলনা হয় না। কিন্তু দেখ, আজ তোমাদের হাতে প্রাণ হারালে আমার নাম পর্যন্ত কোথাও উচ্চারিত হবে না। অথচ রক্ষীদের মতো আমিও তোমাদের বন্দি করার জন্যই প্রাণ বিপন্ন করছি। অতএব দেখছ, গুপ্তচরের দেশপ্রেমের কোনো পুরস্কার নেই।