বাধা দিয়ে কর্ণদেব বলল, তাহলে একদিন সেই সমাজবিরোধী ব্যক্তির মৃতদেহ রাজ্যের মধ্যেই কোনো এক স্থানে আবিষ্কৃত হয় এবং দেখা যায় ওই মৃতদেহের ললাটে বা বক্ষে আঁকা আছে রক্তাক্ত শায়ক চিহ্ন। লোকে বলে দেবরাজ বাসব স্বহস্তে ওই দুবৃত্তের প্রাণদণ্ড দিয়ে তার দেহে শায়ক চিহ্নের প্রতীক অঙ্কিত করেন। যে কথা এই রাজ্যের শিশুরাও জানে, এই মুহূর্তে সেই প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করছ কেন?
পরন্তপ বলল, জানা বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলে কখনো কখনো অজানা রহস্যেরও সমাধান হয়। কর্ণদেব। তুমি শিক্ষিত সাধারণ শিক্ষা নয়, পণ্ডিত পিতার তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন শাস্ত্র ও দর্শন অধ্যয়ন করেছ তুমি কি বিশ্বাস করো দেবরাজ ইন্দ্র স্বহস্তে রাজশত্রুকে হত্যা করে সেই ব্যক্তির ললাটে বা বক্ষে প্রতীক চিহ্ন অঙ্কন করেন?
ক্ষণকাল চিন্তা করে কর্ণদেব বলল, না। ও কথা আমি বিশ্বাস করি না।
পরন্তপ আবার প্রশ্ন করল, তাহলে শায়ক চিহ্নে কেন চিহ্নিত হয় নিহত ব্যক্তির ললাট বা বক্ষ? সকলের অজ্ঞাতে ওই দুরূহ কর্মটি কে সমাধা করে?
চিন্তিত স্বরে কর্ণদেব বলল, তা বলতে পারি না। তবে কোনো অদৃশ্য দৈবশক্তি যে এই সকল ঘটনার সঙ্গে জড়িত, সে কথা আমি বিশ্বাস করি না। যে ভাবেই হোক কোনো ব্যক্তি জনসাধারণের অজ্ঞাতসারে দুর্বৃত্তদের সন্ধান নিয়ে তাদের সম্মুখীন হয়, তারপর গোপনে তাদের হত্যা করে চলে যায়। তবে যে ব্যক্তি এই কাজ করে, সে যেমন চতুর, রণবিদ্যায় তেমনই দক্ষ। কারণ, জনারণ্যে লুক্কায়িত দুৰ্বত্তের সন্ধান পাওয়া খুবই কঠিন। তারপর তাকে সম্মুখযুদ্ধে হত্যা করাও সহজ কাজ নয়। নিহত ব্যক্তিদের যে অতর্কিতে আক্রমণ করে গুপ্তভাবে হত্যা করা হয় না, সেই প্রমাণও আছে। ওই সকল নিহত ব্যক্তির দেহে অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন পরীক্ষা করে অভিজ্ঞ প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন যে ওই ধরনের ক্ষতচিহ্নের উৎপত্তি হতে পারে দ্বন্দ্বযুদ্ধের ফলে– গুপ্তঘাতকের আঘাতে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয় তার ধরন অন্যরকম। তাছাড়া, গুপ্তঘাতক সাধারণত ছুরিকা ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু শায়ক চিহ্নিত ব্যক্তিদের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করে দেখা গেছে অধিকাংশ সময়েই তারা মৃত্যুবরণ করেছে তরবারির আঘাতে। মৃত্যুর পর হন্তারক নিহতের দেহে অঙ্কন করেছে শায়ক চিহ্ন। দুই একটা ব্যতিক্রম আছে। প্রায় তিন বৎসর আগে রাজধানীর পথপ্রান্তে দস্যু বিলোমের যে মৃতদেহ ছিল, তাতে অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন ছিল না। ললাটে ও বক্ষে উভয় স্থানেই ছিল রক্তাক্ত শায়ক চিহ্ন। কিন্তু এই সকল আলোচনার প্রয়োজন কি পরন্তপ?
কর্ণদেবের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পরন্তপ বলল, বিলোমের মৃত্যু আমার মনে আছে। আরও কয়েক বৎসর আগে কল্মষপাদ নামে এক দস্যুর মৃতদেহ দেখেছিল আমার এক অনুচর। তার মুখে শুনেছি ওই দস্যর ললাটে ছিল শায়ক চিহ্ন আঁকা, কিন্তু তার দেহে ছিল না অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন। এখন বলো তো কর্ণদেব– শুধু মাত্র ললাটে রক্তাক্ত একটি চিহ্ন ধারণ করে কোনো ব্যক্তি যদি মৃত্যুবরণ করে, তাহলে দেবরোষে তার মৃত্যু ঘটেছে একথা বলা যায় কিনা?
কর্ণদেব বলল, না। আমি যুক্তিবাদী, প্রত্যক্ষ যুক্তি ছাড়া কিছু বিশ্বাস করি না। আমি জানি প্রচণ্ড শক্তিশালী কোনো পুরুষের মুষ্ট্যাঘাতের ফলে হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে আহত ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে; কিন্তু সেই আঘাতের চিহ্ন মৃতের দেহে লক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনাই নেই। খুব সম্ভব ওই ভাবেই দস্যু বিলোম আর কল্মষপাদ প্রাণ হারিয়েছে। হত্যার পর হন্তারক নিহতদের শায়ক চিহ্নে চিহ্নিত করে স্থান ত্যাগ করেছে।
ঠিক বলেছ, পরন্তপ বলল, এখন বলো তো নিহত ব্যক্তির ললাটে বা বক্ষে শায়ক চিহ্নের উৎপত্তি কি করে হতে পারে?
একটু চিন্তা করে কর্ণদেব বলল, বলতে পারছি না।
আরও একটি বিষয় ভেবে দেখা উচিত, পরন্তপ বলল, শায়ক চিহ্নে চিহ্নিত মৃতদেহ যখন দেখা যায়, সেই সময় রুদ্রদমন রাজ্যে উপস্থিত থাকেন না। আরও বিশদভাবে বললে বলতে হয়, মহারাজের রাজবপু যতক্ষণ সিংহাসনে শোভা পায়, ততক্ষণ অবাঞ্ছিত দস্য নিরাপদ। মহারাজ সিংহাসন ত্যাগ করে রাজ্য থেকে অন্তর্হিত হওয়ার পরেই অপরাধীর প্রাণসংশয় ঘটে। কর্ণদেব। মহারাজের সিংহাসন ত্যাগ করে অন্তর্ধান করার সঙ্গে অপরাধীর মৃত্যু আর শায়ক চিহ্নের রহস্য জড়িত আছে। এইবার সব রহস্যের মীমাংসা করো। দেখি, তুমি কেমন বুদ্ধিমান?
কিছুক্ষণ নীরব থেকে কর্ণদেব বলল, না, পরালাম না।
পারবে, পরন্তপ বলল, বন্ধুবর শশকের বামহস্তের অঙ্গুরীয়টি পরীক্ষা করলেই রহস্যের সমাধান করতে পারবে।
নিকটেই উপবিষ্ট শশকের বামহস্তের অনামিকাতে পরিহিত অঙ্গুরীয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে কর্ণদেব বলল, অঙ্গুরীয়টির মধ্যে আমি কোনো বৈশিষ্ট্য দেখতে পাচ্ছি না। অধিকাংশ ব্যক্তি অবশ্য স্বর্ণ বা রৌপ্য নির্মিত অঙ্গুরীয় পরিধান করে থাকে, তবে অন্যান্য ধাতুতে গঠিত অঙ্গুরীয় মাঝে মাঝে দৃষ্টিগোচর হয়। তবে অঙ্গুরীয়ের মধ্যস্থলে প্রস্তর বা রত্ন না থাকলেও সাধারণত ওই অংশটি চতুষ্কোণ বা বৃত্তাকারে স্ফীত হয়ে থাকে। কিন্তু শশকের অঙ্কুরীয়তে কোথাও চতুষ্কোণ বা বৃত্তাকার স্ফীতি নেই, আগাগোড়া সুগোল। ওই ধরনের অঙ্গুরীয় সংখ্যায় কম হলেও একেবারে বিরল এ কথা বলা যায় না। বিশেষত শ্রমজীবী দরিদ্র শ্রেণির মানুষের আঙুলে ওই প্রকার ধাতুনির্মিত অঙ্গুরীয় অনেক সময়েই চোখে পড়ে। আমি তো শশকের অঙ্গুরীয়তে কোনো বৈশিষ্ট্য দেখতে পাচ্ছি না।