দারুণ উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠে কর্ণদেব বলল, কি নিদারুণ বার্তা! শশক! তুমি মহারাজ রুদ্রদমনের গুপ্তচর?
শান্ত স্বরে শশক বলল, তাহলে তো বহু পূর্বেই আমার ইঙ্গিতে অনার্য সেনা তোমাদের বন্দি করত।
আশ্বস্ত হয়ে কর্ণদেব বলল, হ্যাঁ, এটা যুক্তিসঙ্গত কথা।
পরন্তপ বলল, আমাদের বন্দি না করার পিছনে অন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে। অনার্যদের হাতে বন্দি হলে দৈবক্রমে আমাদের মধ্যে কেউ গুপ্তধনের সংবাদ বলে ফেলতে পারে এই সম্ভাবনার বিষয় চিন্তা করেই হয়তো শশক আমাদের বন্দি করতে দেয়নি। অথবা আরও গাঢ় গোপন উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
বিচলিত হয়ে কর্ণদেব বলল, আরও গুঢ় উদ্দেশ্য?… নাঃ! যা শুনলাম, তাতেই আমি চমকিত হয়েছি। এখন তো তাহলে
বাক্য অসম্পূর্ণ রেখে সে শশকের দিকে দৃষ্টিপাত করল, দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত হল তরবারির হাতলের দিকে।
শশক বাক্য ব্যয় করল না। অটল হয়ে বসে রইল। কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি এখন দুরমনস্কের মতো নয়, নিবিষ্টচিত্তে সে সঙ্গীদের লক্ষ্য করছে তার দেহের ভঙ্গি লক্ষন-উদ্যত ব্যাঘ্রের ন্যায় ঈষৎ সঙ্কুচিত- স্থির, কিন্তু প্রতীক্ষায় ভয়ঙ্কর।
সেইদিকে একবার তাকিয়েই কর্ণদেবের দিকে ফিরল পরন্তপ, শান্ত হও কর্ণদেব। স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন হলেও স্বপ্ন; তার সঙ্গে বাস্তবের যোগাযোগ নেই।
ভ্রূ কুঞ্চিত করে কর্ণদেব বলল, কিন্তু তোমার স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবের যোগাযোগ আছে মনে হয়।
আহা! তুমি অনর্থক উত্তেজিত হচ্ছ, পরন্তপ বলল, স্বপ্নের কথা শুনে যদি কেউ উত্তেজিত হয়, তাহলে আমি তাকে দুর্বলচিত্ত মানুষ বলব। তুমিও একটু আগে আমকে দুর্বলচিত্ত বলে দোষারোপ করেছ- নয় কি কৰ্ণদেব?
-সত্য। কিন্তু তোমার দুঃস্বপ্ন যে আমাকেও ভীত করে তুলেছে।
অথচ আমাদের বন্ধু শশক কেমন নির্বিকার দেখেছ? আমার দুঃস্বপ্নের আতঙ্ক তাকে স্পর্শমাত্র করেনি। শশক আদর্শ পুরুষ। দেহের মত তার মনও বলিষ্ঠ।
শশক কোনো কথা বলল না। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে। কিন্তু তার বসার ভঙ্গি শিথিল নয়- শ্বাপদের ন্যায় ঋজু, সতর্ক।
একবার সেইদিকে দৃষ্টিপাত করে পরন্তপ কর্ণদেবের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল, আর একটি স্বপ্ন বৃত্তান্ত বলছি, শোনো। দেখলাম সন্ধ্যাকালে তির নিক্ষেপ করে শশক একটি বন্য বরাহকে হত্যা করল। তারপর সেই মৃত পশুকে স্কন্ধে বহন করে সে যখন ফিরে আসছে, সেই সময় অরণ্য ভেদ করে তার সামনে এসে দাঁড়াল কয়েকজন অস্ত্রধারী অনার্য সেনা। তাদের সঙ্গে শশকের কথাবার্তা আমি শুনতে পাইনি। দেখলাম, একটু পরেই সে ফিরে এল তোমাদের কাছে। তোমরা একটি নদীতটে বিশ্রাম করছিলে। শশকের স্কন্ধে বরাহ দেখে সকলেই আসন্ন ভোজের সম্ভাবনায় সোল্লাসে অভিনন্দন জানালে। তারপর কি হল মনে নেই, কারণ, তখনই আমার স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছিল।
কর্ণদেব উৎকণ্ঠিত স্বরে বলল, আমার মনে আছে একদিন সন্ধ্যায় আমরা যখন নদীতটে বসেছিলাম, সেই সময় সত্যই তিরবিদ্ধ এক বরাহের মৃতদেহ নিয়ে এসেছিল শশক এবং সেই মাংসে আমরা ক্ষুন্নিবৃত্তি করেছিলাম। আমার একথাও মনে আছে–শশক মৃগয়ার জন্য বনমধ্যে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই তুমি হঠাৎ ফলাহারের ইচ্ছা প্রকাশ করলে এবং সুমিষ্ট ফলের সন্ধানে অদৃশ্য হলে অরণ্যগর্ভে। শশক বরাহ নিয়ে প্রত্যাবর্তন করার একটু পরেই শুন্য হাতে ফিরে এসে তুমি জানিয়েছিলে ফলের সন্ধান পাওয়া যায়নি। সেদিন হঠাৎ অরণ্যজাত ফলের উপর তোমার অস্বাভাবিক আকর্ষণ দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম, কিন্তু আজ বুঝতে পারছি তুমি গোপনে শশককে অনুসরণ করেছিলে। সম্ভবত তার আগেই অনার্য প্রহরীর সঙ্গে শশকের দৃষ্টিবিনিময় তোমাকে শশকের গতিবিধি সম্পর্কে সন্দিহান করে তুলেছিল।… কিন্তু কি ভয়ানক ব্যাপার! শশক। পরন্তপের অভিযোগ শোনার পর তোমার কি বলার আছে?
শশক নির্বিকার স্বরে বলল, কিছু না। কারও স্বপ্ন-বৃত্তান্ত নিয়ে মতামত প্রকাশ করতে আমি রাজি নই।
কর্ণদেব ক্রুদ্ধস্বরে বলল, তুমি গুপ্তচর!
শশক কিছু বলার আগেই পরন্তপ বলে উঠল, ভুল ধারণা। আমি জানি শশক গুপ্তচর নয়।
পরস্পর বিরোধী মন্তব্যে হতচকিত কর্ণদেব বিহ্বল স্বরে বলল, গুপ্তচর নয়?
দৃঢ়স্বরে পরন্তপ বলল, না। শশক যে গুপ্তচর নয় এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ।
স্তম্ভিত কর্ণদেব জিজ্ঞাসা করল, তবে সে কী? তুমি এতক্ষণ যা যা বললে তাতে তো তাকে, গুপ্তচর বলেই সন্দেহ হয়।
পরন্তপ হাসল, বন্ধুবর শশক যা বলল, আমি সেই কথারই পুনরুক্তি করব। স্বপ্ন-বৃত্তান্ত শুনে কোনো ব্যক্তিকে দোষারোপ করা যায় না।
কর্ণদেব কি যেন বলতে গেল, কিন্তু তাকে মুখ খোলার সুযোগ না দিয়ে পরন্তপ বলে উঠল, শ্রাবস্তী রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি এবং মহারাজ রুদ্রদমনের গতিবিধি সম্পর্কে তোমার কি মনে হয় কর্ণদেব?
কর্ণদেব রুষ্টস্বরে বলল, আমার মনে হয় মদ্যপান না করেও তুমি আজ নেশাগ্রস্ত হয়েছে। স্বপ্নবৃত্তান্ত ছেড়ে হঠাৎ মহারাজ রুদ্রদমন আর শ্রাবস্তী রাজ্যের প্রসঙ্গ তোমার মাথায় এল কেন? এমন অসংলগ্ন কথাবার্তার অর্থ কি?
অসংলগ্ন নয় হে, অসংলগ্ন নয়, পরন্তপ হাসল, আমার স্বপ্ন-বৃত্তান্তের সঙ্গে মহারাজ রুদ্রদমন আর শ্রাবস্তী রাজ্যের প্রসঙ্গ জড়িত আছে। কণ! তুমি নিশ্চয়ই জানো, যখন কোনো ব্যক্তিকে রাজদরবার থেকে সমাজবিরোধী আখ্যা দিয়ে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়, তখন সেই ব্যক্তি যদি রাজাদেশ পালন না করে, অথবা দেশান্তরী না হয় তাহলে