পরন্তপ হেসে বলল, তা তো করতেই হবে। তবে তার আগে আমার কয়েকটা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলে ক্ষতি কি?
জিজ্ঞাসু চক্ষে পরন্তপের দিকে তাকাল কর্ণদেব। গুহার দ্বারপথে আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেল শশক।
» ১৯. অসি বাজে ঝন্ ঝন্
গুহার মধ্যস্থলে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড থেকে রক্তাভ আলোকধারা ছড়িয়ে পড়ছে অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে… আলোছায়ার খেলায় কয়েকটা ভৌতিক ছায়া লাফিয়ে উঠছে উপবিষ্ট তিনটি মানুষের মুখের উপর, দেহের উপর… অদুরে গুহাতলে নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে দুটি মৃতদেহ… একটি মৃতদেহের মস্তক বিদীর্ণ করে আড়াআড়িভাবে অবস্থান করছে একটি শাণিত তরবার এবং গুহাতলে শুষ্ক মৃত্তিকা ও কঠিন প্রস্তরের বুক ভাসিয়ে ছুটছে বিদারিত ক্ষতস্থান থেকে তপ্ত রক্তের ধারা…
সেই ভয়াবহ পরিবেশের স্তব্ধতা ভঙ্গ করে জাগল পরন্তপের কণ্ঠস্বর, কিছুদিন ধরেই আমি দুঃস্বপ্ন দেখছি। শুধু রাত্রে নয়, দিবালোকেও জাগ্রত অবস্থায় ওই স্বপ্ন আমাকে তাড়া করে ফিরছে। এতদিন বলতে পারি নি। কিন্তু এবার বলার সময় হয়েছে। মনে হয়, বন্ধুবর শশক আমাকে এই দুশ্চিন্তার কবল থেকে মুক্ত করতে পারবে।
একটু থেমে শশকের দিকে রহস্যময় ভঙ্গিতে কটাক্ষ করল পরন্তপ। বিভ্রান্তের মতো একবার পরন্তপ আর একবার শশকের মুখের দিকে চাইল কর্ণদেব পরন্তপের ইঙ্গিত তার বোধগম্য হচ্ছে না, কিন্তু কি যেন এক দুর্বোধ্য রহস্যের আভাস রয়েছে দস্য দলপতির কণ্ঠস্বরে।
শশকের মুখ পাথরের মত নির্বিকার। তার চোখের দৃষ্টি সঞ্চরণ করছে গুহার বাইরে অন্ধকার বনভূমির বুকে;- পরন্তপের দিকে না তাকিয়েই সে উদাস স্বরে বলল, প্রিয়বন্ধু পরন্তপকে দুশ্চিন্তার কবল থেকে মুক্তি দেওয়া আমার সাধ্য নয়। আমি জ্যোতিষী নই– যোদ্ধা।
বন্ধুবর শশকের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির উপর আমার অগাধ আস্থা, পরন্তপ সহাস্যে বলল, আর সে যে কী, আর কী সে নয়- তা আমি এখনও বুঝতে পারি নি তবে বুঝতে চেষ্টা করছি। যাই হোক, দুঃস্বপ্নের বৃত্তান্ত তোমাদের বলে হয়তো কিছুটা শান্তি পাব।
কর্ণদেবের মুখে ফুটল বিরক্তির আভাস, পরন্তপ! তোমার চিত্ত দুর্বল হয়ে পড়ছে। দুঃস্বপ্ন দেখে বিচলিত হওয়ার মতো দুর্বল মানুষ তো তুমি ছিলে না।
হয়তো তোমার কথা সত্য, পরন্তপের মুখের হাসি রহস্যময়, তবু অনুগ্রহ করে আমার কথা শোন। আমার বিশ্বাস, সকল বৃত্তান্ত শ্রবণ করলে তোমরা দুজনেই আমার চিত্তের দুর্বলতা দূর করতে সমর্থ হবে।
শশক পূর্বের মতোই নীরব। কর্ণদেব বলল, বেশ, শুনি তোমার দুঃস্বপ্নের বৃত্তান্ত।
পরন্তপ বলতে লাগল, একদিন স্বপ্ন দেখলাম এক পার্বত্যপথের উপর দিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি হঠাৎ চোখে পড়ল পাহাড়ের গায়ে গা মিলিয়ে বসে আছে এক অনার্য প্রহরী! তার সম্পূর্ণ দেহ আমার দৃষ্টি সীমার মধ্যে ধরা না পড়লেও লোকটির অস্তিত্ব আমার কাছে গোপন রইল না। আমি জানি, ওরা এককভাবে থাকে না; আশে-পাশে নিশ্চয়ই অন্যান্য যোদ্ধারা অপেক্ষা করছে পাহাড় ও অরণ্যের অন্তরালে লুক্কায়িত হয়ে। চিৎকার করে তোমাদের সতর্ক করার চেষ্টা করলাম না। কারণ, তাহলে তারা আমাদের চারদিকে থেকে বেষ্টন করবে; আর একবার পরিবেষ্টিত হলে আত্মসমর্পণ অথবা যুদ্ধ ছাড়া নিষ্কৃতি লাভের অন্য উপায় থাকবে না। আত্মসমর্পণ করলে অনার্যরাজের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে এবং সেই কৈফিয়ত সন্তোষজনক না হলে সীমান্ত অভিমুখে আমাদের চলার পথ বন্ধ হয়ে যাবে অনার্যরাজের আদেশে। যুদ্ধের কথা ভাবলাম, ফল খুব আশাপ্রদ হবে বলে মনে হল না। সঙ্কীর্ণ গিরিপথে দুর্ধর্ষ অনার্য সেনার সঙ্গে যুদ্ধ করে যদি তাদের বহভেদ করতে পারি, তাহলেও আমরা সকলে অক্ষতদেহে মুক্তি পাব কিনা সন্দেহ। বিশেষ করে শশকের কিছু হলে সমূহ বিপদ- কারণ, নরমুণ্ডের পাহাড়ের অবস্থিতি সে ছাড়া আর কারও জানা নেই। অনার্যদের সঙ্গে একবার যুদ্ধ করার পর তাদের অধিকারভুক্ত অঞ্চলে চলাফেরা করা অসম্ভব হয়ে উঠবে। সেই অবস্থায় অনুসন্ধান করে করোটি পাহাড়কে আবিষ্কার করা শুধু দুঃসাধ্য নয়, প্রায় অসম্ভব। ভাবলাম, ধীরে ধীরে এক এক করে তোমাদের পাশে গিয়ে নতস্বরে সকলকে সাবধান করে দেব। একবার সমতল ভূমিতে পড়লে বিপদের আশঙ্কা কম– অন্তত পলায়নের পথ কিছুটা সহজ হবে। কিন্তু তোমাদের কাছে গিয়ে কিছু বলার দরকার হল না;- হঠাৎ দেখলাম বন্ধুবর শশকের সঙ্গে ওই অনার্য প্রহরীর দৃষ্টি বিনিময় ঘটল। আমি অন্যমনস্ক হওয়ার ভান করলাম। শশক জানতেও পারল না আমি তাকে লক্ষ্য করেছি। তারপর
বাধা দিয়ে উত্তেজিত স্বরে কর্ণদেব বলল, এই ঘটনার একটাই অর্থ হতে পারে। শশকের সঙ্গে নিশ্চয়ই অনার্যদের যোগযোগ আছে। আর্যযোদ্ধা শশকের সঙ্গে অনার্য-প্রহরীর এমনকি সম্প্রীতির কারণ থাকতে পারে?… শশক! তুমি কি অনার্যরাজের গুপ্তচর?
শশক কিছু বলার আগেই পরন্তপ বলে উঠল, আহা! এটা তো স্বপ্ন। অত্যন্ত দুর্বিষহ এক দুঃস্বপ্ন। কিন্তু যদি এটা স্বপ্ন না হয়ে বাস্তব সত্য হয়, তাহলে বুঝতে হবে অনার্যদের সঙ্গে এমন সম্প্রীতির একটাই কারণ থাকতে পারে।
কর্ণদেব প্রশ্ন করল, কি কারণ?
পরন্তপ বলল, এই পথে বারংবার যাতায়াতের ফলে শশকের সঙ্গে অনার্যদের বন্ধুত্ব হতে পারে। কিন্তু যত বন্ধুত্বই থাক, চারটি সশস্ত্র মানুষকে শশকের সঙ্গে সীমান্তের দিকে যেতে দেখলে অনার্য-প্রহরী তাদের পথরোধ করবেই করবে। অনার্যরাজ মূলক এই অঞ্চলে অধিক সংখ্যক অস্ত্রধারী ব্যক্তির অস্তিত্ব পছন্দ করে না। কারণ, রাজদ্রোহী প্রজা অথবা শত্রুপক্ষের গুপ্তচরের পক্ষে এই অঞ্চলের কোনো ধ্বংসাত্মক কার্যে লিপ্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়, এবং সেই রকম কিছু ঘটলে শ্রাবস্তী রাজ্য হবে বিপন্ন। আমরা জানি মহারাজ রুদ্রদমনের অন্তরঙ্গ সুহৃদ এই অনার্যরাজ শ্রাবস্তীর আপদ-বিপদ সম্পর্কে অতিশয় সচেতন। তাই এই অঞ্চলে অধিক সংখ্যক সশস্ত্র পুরুষ চলাফেরা করলেই প্রচলিত প্রথা অনুসারে তার প্রহরীরা আগন্তুকদের পথরোধ করে প্রশ্ন করবে- প্রশ্নের উত্তর সন্তোষজনক না হলে তাদের নিয়ে যাবে রাজ সকাশে। শশকের সান্নিধ্য যদি এই নিয়মের অন্যথা হয়, তাহলে বুঝতে হবে সে মহারাজ রুদ্রদমনের গুপ্তচর, অনার্যদের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। গুপ্তধন আবিষ্কারের পরেই সম্ভবত অনার্যরা আমাদের বন্দি করবে।