ধন্যবাদ! অশেষ ধন্যবাদ!
কিশোরের সঙ্গী অন্যদিকে চলে গেল। কিশোর এগিয়ে গেল জনতার দিকে…
আসুন! দেখুন! জয়দ্রথ তার অসীম শক্তির পরিচয় দিচ্ছে, দণ্ডায়মান মানুষগুলোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে ব্যাঘ্রচর্মে সজ্জিত এক ভীমকান্তি পুরুষ ঘোষণা করছিল, জয়দ্রথ আপনাদের কিয়ৎকাল আনন্দ দেবে। বিনিময়ে তাকে আপনারা কিছু পুরস্কার দেবেন বলে সে আশা করে।
জনতার ভিতর থেকে এক রসিক পুরুষ সরস মন্তব্য নিক্ষেপ করল, আনন্দের ধরনটা আগে দেখি। তারপর বিবেচনা করব তোমার প্রাপ্য কি হবে পুরস্কার- না, তিরস্কার!
জয়দ্রথ নামক ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিত মানুষটি জনতার ভিতরে দৃষ্টিকে সঞ্চালিত করল, কিন্তু রসিক ব্যক্তিটিকে আবিষ্কার করতে পারল না।
কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে সে নীরবতা ভঙ্গ করল, আমি মল্লযোদ্ধা। আমার প্রতিযোগী কোনো মল্ল এখানে উপস্থিত থাকলে আমি মল্লযুদ্ধের কৌশল দেখিয়ে আপনাদের আনন্দ বিতরণ করতে পারতাম। যিনি এইমাত্র আমাকে তিরস্কারের সম্ভাবনা জানিয়ে সতর্ক করেছেন, তার চেহারাটা আমি দেখতে চাই এবং আমাকে তিরস্কার করার ক্ষমতা তিনি রাখেন কি না সেটাও পরীক্ষা করতে চাই। আমার বিশ্বাস, উপস্থিত জনমণ্ডলী তাতে কিছু আনন্দ পাবেন, আর সেই আনন্দের বিনিময়ে দরিদ্র এই মল্লযোদ্ধাকে পুরস্কৃত করতে তাদের আপত্তি হবে না.. কই? কথাটা যিনি বললেন তাঁকে দেখতে পাচ্ছি না কেন? আসুন!
সবাই চুপ। কেউ এগিয়ে এল না। জয়দ্রথ আবার বলল, আপনারা কেউ ব্যবসাবাণিজ্য করেন, কেউ বা বণিকগৃহে অথবা রাজদ্বারে মাসিক বেতনের কর্মচারী। আপনারা বুদ্ধিজীবী; দেশ আপনাদের প্রয়োজন অনুভব করে একথা সত্য। কিন্তু শুধু মস্তিষ্কের শক্তি থাকলেই হয় না, দেহের শক্তিরও প্রয়োজন আছে আমাদের দেশে–একথা ভুললে চলবে না। সুস্থ বলিষ্ঠ দেহ জাতির সম্পদ। আমি শক্তির পূজারী, বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী আমাকে অপমান করার অধিকার আপনাদের নেই।
দণ্ডায়মান মানুষগুলোর মুখের ওপর ঘুরতে লাগল জয়দ্রথের তীব্র দৃষ্টি, কয়েক মুহূর্ত পরে স্তব্ধতা ভঙ্গ করে আবার জাগ্রত হল তার গম্ভীর কণ্ঠ, যদি আমার খেলা দেখে আনন্দ পাবেন বলে মনে করেন, তাহলে দাঁড়িয়ে দেখুন। না হয়তো, চলে যান। কিন্তু আমি খেলা দেখানোর আগেই দেখে নিতে চাই আমি কি পাচ্ছি! প্রয়োজনীয় অর্থ না পেলে আমি বৃথা শক্তিক্ষয় করে দেহের ক্ষতি করতে রাজি নই। আমার দেহ অতিশয় মূল্যবান। বহু চেষ্টায় এই দেহ গড়ে উঠেছে।… যদি খেলা দেখতে চান তো রাজপথে সাধ্য অনুযায়ী অর্থ ফেলুন।
ঠং করে একটি তাম্রমুদ্রা জয়দ্রথের সামনে মাটিতে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই শব্দ। তারপর কিছুক্ষণ ঠং, ঠং, ঠং, ঠং…।
ধাতব শব্দের ঝঙ্কার থেমে যেতেই জয়দ্রথ পথের উপর নিক্ষিপ্ত অর্থ গণনা শুরু করল… কিছুক্ষণ পর মাথা নেড়ে বলল, হবে না। যে যার অর্থ তুলে নিন। ত্রিশ কাহন, পাঁচ নিষ্ক দিয়ে এই দেহের জন্য একবেলার উপযুক্ত খাদ্য সরবরাহ করা যায় না।
কেউ এগিয়ে এল না। নিক্ষিপ্ত মুদ্রা রাজপথ থেকে কুড়িয়ে নেওয়া দাতার পক্ষে সম্মানজনক নয়।
জয়দ্রথ মৃদু হেসে নত হয়ে তাম্রমুদ্রাগুলি (রজতমুদ্রা একটিও ছিল না) কুড়িয়ে নিয়ে কটিবন্ধের চর্মপেটিকায় রাখল, তারপর বলল, আপনারা যখন ওই অর্থ ফিরিয়ে নিতে রাজি নন, তখন আমিই ওগুলো তুলে নিলাম। শক্তিমান পুরুষ দেশের সম্পদ। এই সামান্য অর্থ দান করে আপনারা দেশের প্রতি আপনাদের আনুগত্য প্রমাণ করলেন। বজ্ৰপাণি বাসব আপনাদের কল্যাণ করুন।
জনৈক ব্যক্তি ক্রোধপ্রকাশ করে বলল, তুমি খেলা দেখাবে না?
-খেলা দেখাতেই এসেছিলাম। কিন্তু পূর্বেই বলেছি, ত্ৰিশ কাহন পাঁচ নিষ্ক দিয়ে এই বৃহৎ দেহের উপযোগী একবেলার খাদ্য ক্রয় করা যায় না। কঠিন পরিশ্রমে দেহ শ্রান্ত হলে উপযুক্ত খাদ্য ও বিশ্রাম দিয়ে সেই দেহের পরিচর্যা করলে বলবান হওয়া যায়– অন্যথা বিপরীত অবস্থাই ঘটবে, অর্থাৎ শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে।
জনতার মধ্যে যারা অর্থ নিক্ষেপ করেছিল, তাদের মধ্যে অনেকেই সরোষে অধর দংশন করল। কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করতে সাহসী হল না।
একটি ক্ষুদ্র শকট পথের একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। শকটের একপাশে হাতল লাগানো দেখলেই বোঝা যায় ওই ক্ষুদ্রাকার যান হাতের সাহায্যে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার জন্যে তৈরি হয়েছে। শকটের উচ্চতা হাত দুই-এর বেশি নয়। শকটগর্ভে কি আছে জানার উপায় নেই। স্থূল ও কর্কশ রঙিন বস্ত্রে শকটপৃষ্ঠ ঢেকে দেওয়া হয়েছে। তবে বস্ত্রের স্ফীতি দেখে অনুমান করা যায় তার তলায় নিরেট বস্তুপিণ্ডের সমাবেশ ঘটেছে।
শকটের হাতল ঠেলে জয়দ্রথ এগিয়ে গেল। তার চলার পথ ছেড়ে শশব্যস্তে সরে গেল মানুষ।
আচম্বিতে প্রস্থান-উদ্যত জয়দ্রথের পথরুদ্ধ হল- দাঁড়াও!
ভ্রূ কুঞ্চিত করে জয়দ্রথ মুখ তুলল– তার পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে এক সুদর্শন কিশোর।
জয়দ্রথ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে কিশোরের আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করল। বুঝল, বয়স কম হলেও মানুষটি অবহেলার নয়। কটিদেশে লম্ববান তরবারি ও সুদীর্ঘ ছুরিকা বুঝিয়ে দিচ্ছে কিশোর অস্ত্রচালনায় অভ্যস্ত। দেহের গঠন ছিপছিপে; চিতাবাঘের মতো দীর্ঘ, পেশল, প্রাণসার।
জয়দ্রথ গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করল, দাঁড়াব কেন?