সকলেই জিজ্ঞাসু নেত্রে শশকের মুখের পানে দৃষ্টিপাত করল।
বিশ্বাস হচ্ছে না? শশক বলল, তবে শোনো। আমরা যে করোটি পর্বতের কাছে এসে পড়েছি সেকথা তো আগেই বলেছি। কিন্তু কাছে বলতে কত কাছে, সে ধারণা তোমাদের নেই। একদিন! আর মাত্র একদিনের পথ চললেই আমরা যথাস্থানে পৌঁছে যাব।
–অহো! অপূর্ব বার্তা!
–সাধু! সাধু!
-ঈশ্বর তোমাকে দীর্ঘজীবী করুন!
মধু! মধু! তোমার রসনা যেন মধুবৰ্ষণ করল!
সকলে সবিস্ময়ে আবিষ্কার করল পলাতক জঠরাগ্নি আবার যথাস্থানে প্রত্যাবর্তন করেছে।
১৮. পর্বতশিখরে বিপর্যয়
শল্যের বর্ণনায় একটু ভুল ছিল। পাহাড়টি নরমুণ্ডের মতো নয়। তবে তার বৈশিষ্ট্য রয়েছে সানুদেশে। গিরিচূড়ায় অবিস্থত প্রশস্ত প্রাঙ্গণের ন্যায় বিস্তৃত পাষাণ-চত্বরের উপর থেকে উঠে গেছে প্রস্তর ও মৃত্তিকায় জড়িত নরমুণ্ডসদৃশ একটি স্তূপ। ভাস্করের ছেনি ও বাটালির আঘাতে গঠিত হয়নি ওই নরমুণ্ড- প্রকৃতির আশ্চর্য খেয়ালে যুগ যুগ ধরে বৃষ্টির ধারা, সূর্যতাপ, বজ্রপাত ও নানাবিধ দুর্যোগে ক্ষতবিক্ষত ওই ভূপটি ধীরে ধীরে মাংসহীন ব্যাদিতবদন নরমুণ্ডের আকার ধারণ করেছে। দূর থেকে মনে হয় বিকট হাস্য মুখব্যাদন করে আছে সুবিশাল এক কঙ্কালমুণ্ড!
ওই মুখবিবরই হচ্ছে গুহার প্রবেশপথ। ওইখানেই রয়েছে শল্যের লুণ্ঠিত সম্পদ; যে সম্পদের লোভে মরণ তুচ্ছ করে ছুটে এসেছে চারটি দুঃসাহসী মানুষ, এবং পরবর্তীকালে রহস্যময়ী নিয়তির চক্রান্তে ওই চার সংখ্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও একটি সংখ্যা পাঁচ!
সন্ধ্যার প্রাক্কালে পূর্বোক্ত পাঁচটি জীবন্ত সংখ্যা এসে দাঁড়াল ব্যাদিতহাস্য কঙ্কালমুণ্ডের সম্মুখে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে পরন্তপ বলল, সন্ধ্যা আগত। এখনই সব অন্ধকার হয়ে যাবে।
শায়ন বলল, তবে চলো, ভিতরে প্রবেশ করি। অন্ধকার হওয়ার আগেই একবার ভিতরে ঢুকে দেখতে পারি ওখানে কি আছে।
তার কণ্ঠস্বরে উত্তেজনার রেশ গোপন রইল না।
কর্ণদেব বলল, হ্যাঁ, আমিও একবার ভিতরে প্রবেশ করতে চাই। একটু পরেই অন্ধকার এসে আমাদের দৃষ্টিকে অন্ধ করে দেবে।
বল্লভ বলল, এত অধৈর্য হওয়ার কি প্রয়োজন? অগ্নির সাহায্যে অন্ধকারের বুকে অনায়াসেই আলোকপাত করা যায়।
কর্ণদেব বলল, তোমার যেন বিশেষ আগ্রহ নেই মনে হচ্ছে?
বল্লভ বলল, আগ্রহ না থাকলে এতদুর প্রাণবিপন্ন করে ছুটে আসব কেন? তবে আমার বয়সে অল্পবয়স্ক কিশোরের ন্যায় চাঞ্চল্য প্রকাশ করা অশোভন।
শায়ন বলল, আমি অল্পবয়স্ক কিশোর নই– কিন্তু গুহায় প্রবেশ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছি একথা বলতে লজ্জাবোধ করছি না।
পরন্তপ বলল, দিনের আলো নিবে গেছে। এখানে মুক্ত আকাশের নীচে আমরা এখনও আলোর দেখা পাচ্ছি বটে, কিন্তু গুহার মধ্যে যে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। আগুন না জ্বাললে ওখানে অন্ধকারের মধ্যে কিছুই খুঁজে পাব না।
শায়ন চট করে এগিয়ে গিয়ে গুহার ভিতর দৃষ্টিপাত করেই পিছিয়ে এসে বলল, পরন্তপ। তুমি ঠিকই বলেছ; আগুন না জ্বাললে ওখানে কিছুই আমাদের দৃষ্টিগোচর হবে না…! বল্লভ! আগুনের ব্যবস্থা করো।
কঠিন শুষ্ক মৃত্তিকা ও প্রস্তরের বুক থেকে কোনোক্রমে রস আহরণ করে এখানে-ওখানে কয়েকটি গুল্ম ও তৃণগুচ্ছ আত্মপ্রকাশ করেছে। তাদেরই মধ্যে কিছু উদ্ভিদকে সমূলে উৎপাটিত করে শুষ্ক বৃক্ষশাখা দিয়ে মশাল প্রস্তুত হল– তারপর সেই জ্বলন্ত মশাল দিয়ে সকলে প্রবেশ করল গুহার মধ্যে।
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে গুহার চারদিক বারংবার নিরীক্ষণ করে পরন্তপ বলল, শল্য দেখছি মৃত্যুকালে আমার সঙ্গে পরিহাস করেছে।
কর্ণদেব বলল, তাই বটে। তোমার মুখে শুনেছি গুহার একস্থানে তার নামের আদ্য-অক্ষর খোদিত আছে। কিন্তু এখানে দেখছি চারদিকেই শ অক্ষরের ছড়াছড়ি।
শায়ন বলল, চিহ্নিত স্থানগুলিতে আঘাত করে দেখ। তাতে বিলম্ব হলেও গুপ্তকক্ষ ও গুপ্তধনের সন্ধান নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।
তিক্তস্বরে পরন্তপ বলল, হয়তো পাওয়া যাবে না। কিন্তু মরণকালে পরিষ্কার নির্দেশ না দিয়ে সে আমাদের সমস্যায় ফেলল কেন? চারদিকে রাশি রাশি খোদিত শ অক্ষরের মধ্যে কোথায় কতক্ষণে আমরা গুপ্তধনের সন্ধান পাব?…হাতে অফুরন্ত সময় আছে একথা ভাবলে তোমরা ভুল করবে। অনার্য প্রহরীদের সাক্ষাৎ আমরা পাইনি বটে, কিন্তু যে কোনো সময়ে তারা আমাদের ঘিরে ফেলতে পারে।
এই ভয়াবহ সম্ভাবনার কথা শুনে সকলেই চঞ্চল হয়ে উঠল।
শশক বলল, পরন্তপ! অনার্য প্রহরীরা সাধারণত রাত্রে বনপথে চলাচল করে না, একথা তোমার জানা উচিত। আর গুহার মধ্যে রাশি রাশি শ অক্ষর নিয়ে মস্তিষ্ককে ঘর্মাক্ত না করলেও চলবে। আমার বিশ্বাস, গুহার পশ্চিম দেয়ালে সন্ধান করলে ধনভাণ্ডারের সন্ধান পাওয়া যাবে।
পরন্তপ বলল, পশ্চিম দেয়ালে অবশ্য শ অক্ষরের সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু সবদিক ছেড়ে হঠাৎ পশ্চিম দেয়ালে খুঁজলে গুপ্তধন পাওয়া যাবে এমন কথা তোমার মনে হল কেন?
শশক কোনো কথা না বলে বল্লভের হাত থেকে মশাল নিয়ে গুহার পশ্চিম দেয়ালের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত পদচালনা করল। তারপর হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে একস্থানে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলে উঠল, বোধহয় এইখানেই অভীষ্ট বস্তু অবস্থান করছে। বল্লভ! তুমি হাত চার্লিয়ে দেখতে পারো।