উদ্যত ধনুর্বাণ হস্তে ছুটতে ছুটতে ধাবমান গজরাজের খুব কাছে পৌঁছে গেছে শশক! সেই বিশালদেহী পুরুষ যেন মাটিতে পা ফেলছে না, তার প্রকাণ্ড দেহ যেন মাটির উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে শরীরী বিদ্যুতের মতো…
কর্ণদেবের ধনুক থেকে পর পর অনেকগুলো বাণ ছুটে গিয়ে হস্তীর ললাট, বক্ষ ও গণ্ডদেশকে বিদ্ধ করল, কিন্তু মত্ত মাতঙ্গের গতিরুদ্ধ হল না। পরন্তপ কয়েকটি ছুরিকা নিক্ষেপ করল সজোরে। ছুরিকা হস্তীর দেহে বিদ্ধ হল। গজরাজ সেই আঘাত গ্রাহ্যই করল না। তার বিশাল দেহে ছুরিকার আঘাত বোধহয় মানব দেহে মশক দংশনের মতোই তুচ্ছ। তীব্র বৃংহনে চারদিক কাঁপিয়ে বল্লভের নিকটস্থ হল মত্ত মাতঙ্গ,… কাছে, কাছে,… আরও কাছে..
বল্লভের পায়ের তলায় মাটি কাঁপছে দানবের পদভারে, কর্ণকুহরকে বধির করে জাগছে ঘন ঘন তীব্র বৃংহণ-ধ্বনি- বল্লভ অনুভব করল মৃত্যুদূত একেবারে তার কাছে এসে পড়েছে, আর বুঝি রক্ষা নেই!
হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বল্লভ, কুঠার তুলে রুখে দাঁড়াল। ক্ষুদ্র মানুষের স্পর্ধা দেখে হিংস্র বৃংহণে ক্রোধ প্রকাশ করল দানব, হত্যার উদগ্র আগ্রহে শূন্যে দুলে উঠল যমদণ্ডের ন্যায় প্রকাণ্ড শুণ্ড–
কিন্তু সেই আঘাত যথাস্থানে পড়ার আগেই ছুটে এসে হস্তীর দক্ষিণ পার্শ্ব থেকে বাণ নিক্ষেপ করল শশক। সঙ্গে সঙ্গে আর্ত চিৎকার করে থমকে দাঁড়াল মৃত্যুদূত– তার দক্ষিণ চক্ষু ভেদ করেছে শশকের বাণ!
আঘাতের ফলে হস্তীর প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য অপেক্ষা করল না শশক— একলাফে হস্তীর সম্মুখে এসে পড়ল সে এবং সেখান থেকে আর একলাফে বামপার্শ্বে- পরক্ষণেই জ্যা-মুক্ত বাণ অব্যর্থ সন্ধানে হস্তীর বামচক্ষুতে বিদ্ধ হল।
ভয়ংকর বৃংহণ-শব্দে আকাশ বুঝি ফেটে পড়তে চায়! অন্ধ গজরাজ বিষম আক্রাশে এগিয়ে এল, জান্তব অনুভূতি দিয়ে শত্রুর অবস্থান নির্ণয় করে সজোরে শুণ্ডাঘাত করল।
এক সদীর্ঘ লক্ষে স্থান ত্যাগ করল বল্লভ, সঙ্গে সঙ্গে তার পরিত্যক্ত স্থানে সশব্দে আছড়ে পড়ল হস্তীর ভয়ংকর শুণ্ড!
স্থূলকায় মল্ল অবিশ্বাস্য বেগে ছুটে গেল হস্তীর পিছন দিকে, দুই হাতে কুঠার তুলে ভীমবেগে আঘাত হানল দানবের পিছনে একটি পায়ের উপর। শাণিত কুঠারফলক পশ্চাৎভাগের দক্ষিণ চরণটিকে প্রায় দ্বিধাবিভক্ত করে মাংসের মধ্যে গম্ভীর হয়ে বসল, ফিনকি দিয়ে তপ্ত রক্তধারা সিক্ত করে দিল বল্লভের সর্বাঙ্গ! ভীষণ আর্তনাদ করে মাটিতে জানু পেতে বসে পড়ল হস্তী!
আবার ছুটে এল বল্লভ–এবার পিছনে নয়, সামনে, হস্তীর মস্তকের দক্ষিণপার্শ্বে আবার শূন্যে দুলে উঠল রক্তাক্ত কুঠার, তারপর নিদারুণ বেগে নেমে এল মাথার উপর, প্রচণ্ড আঘাতে বিদীর্ণ হয়ে গেল করিকুম্ভ! ছিটকে পড়ল খণ্ড খণ্ড অস্তি, মজ্জা, মেদ; এবং ধরণীকে লোহিতবর্ণে রঞ্জিত করে ছুটল রক্তনদীর স্রোত!
অস্ফুট আর্তনাদ করে তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করল গজরাজ!…
ছুটতে ছুটতে আর ঘন ঘন শ্বাস ফেলতে ফেলতে বল্লভের পাশে এসে দাঁড়াল শায়ন, তারপর বলল, খুব বেঁচে গেছ বল্লভ! মদস্রাব ঘটলে পুরুষ হস্তী উন্মত্ত হয়ে বিচরণ করে-হস্তিনী ছাড়া অন্য যে-কোনো জীবকেই ওই সময়ে সে হত্যা করতে সচেষ্ট হয়। এই হস্তীও মত্ত অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছিল। এই দেখ, চক্ষুর তলায় ক্ষুদ্র ছিদ্র থেকে ঘন পীতাভ নির্যাস বা মদ নির্গত হয়ে গণ্ডদেহকে প্লাবিত করেছে। মদনিঃস্রাবে সিক্তগণ্ড এই গজরাজ তোমার চিৎকারে আকৃষ্ট হয়ে তোমাকে আক্রমণ করেছিল। অরণ্যে অনর্থক চিৎকার করলে বিপদ ঘটতে পারে একথা মনে রেখো।
পরন্তপ বলল, আজকের ঘটনা আমার চিরকাল মনে থাকবে। ধনুর্বাণে শশকের আশ্চর্য নিশানা আর বল্লভের প্রচণ্ড শক্তির যে পরিচয় পেলাম, তা জীবনে ভুলব না।
শায়ন বলল, শশকের নিশানা দেখে আমি চমকিত হয়েছি। আক্রমণোদ্যত ধাবমান হস্তীর সম্মুখে দাঁড়িয়ে নির্ভুল লক্ষ্যে তার দুই চক্ষুকে বিদ্ধ করতে আমিও পারব না।
কর্ণদেব বলল, বল্লভের কৃতিত্বও কম নয়। কুঠারের আঘাতে হস্তীকে বধ করা কি সহজ কর্ম?
পরন্তপ বলল, একথা সত্য। কেউ কারও চাইতে কম নয়।
বল্লভ বলল, না। শশকের ক্ষমতা আমার চাইতে বেশি। আমার পক্ষে হস্তীর দই চক্ষক বাণবিদ্ধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমি যা করেছি শশকের পক্ষে সেই কাজ অসম্ভব বলে মনে হয় না।
কর্ণদেব বলল, শশক নীরব কেন? কি ভাবছ?
নির্বিকার কণ্ঠে শশক বলল, ভাবছি, হস্তীমাংসেই আজ ক্ষুন্নিবৃত্তি করব।
স্খলিত স্বরে হাস্য করে বল্লভ বলল, একটু আগেও আমি অত্যন্ত ক্ষুধার্ত ছিলাম। কিন্তু এখন আদৌ ক্ষুধাবোধ করছি না।
শায়ন বলল, আহার্যের কথা চিন্তা করলেই আমার বিবমিষা আসছে।
কর্ণদেব বলল, আজ সারাদিনের মধ্যে কোনো বস্তু গলাধঃকরণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
শশক বলল, আমি ক্ষুধার্ত। মৃগমাংসের পরিবর্তে এই হস্তীমাংস অগ্নিতে দগ্ধ করে ক্ষুধানিবারণ করব। শুল্য গজমাংস অতি উপাদেয় আহার্য। একবার এর স্বাদ গ্রহণ করলে জীবনে ভুলতে পারবে না। তোমরা আমার সঙ্গে গজমাংসের ভোজ যোগ দাও।
সমবেত কণ্ঠে উচ্চারিত হল, অসম্ভব।
বন্যহস্তীর আকস্মিক আবির্ভাব এবং রক্তপাতের দৃশ্য তোমাদের স্নায়ুর উপর বিষম প্রতিক্রয়া সৃষ্টি করেছে; ফলে এই ক্ষুধামান্দ্য, শশক হেসে বলল, কিন্তু আমি তোমাদের এমন একটি সংবাদ দিতে পারি, যা শ্রবণ করলই পলাতক জঠরাগ্নি আবার তোমাদের উদরে ফিরে আসবে।