বনের পশুরাও পাঁচ বন্ধুর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেনি। একটা বিষাক্ত সাপ অতর্কিতে পরন্তপের পায়ে ছোবল মারতে ফণা তুলেছিল, সদাসতর্ক শায়ন যদি যথাসময়ে সাপটাকে দেখে তলোয়ারের আঘাতে বধ না করত, তাহলে সেইদিনই শেষ হয়ে যেত পরন্তপের ভবলীলা। আর এক রাত্রে অগ্নিকুণ্ডের ধারে অনেকগুলো মানুষকে শুয়ে থাকতে দেখে একটা প্রকাণ্ড বাঘ কৌতূহলী হয়ে ব্যাপারটা কি দেখতে এল। শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যে সমবেতভাবে নিদ্রিত হলে সেই নিদ্রা চিরনিদ্রায় পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা আছে মনে করে প্রহরে প্রহরে পালা করে অভিযাত্রীরা জেগে থাকত। ব্যাঘ্রের আবির্ভাব যখন ঘটল, সেইসময় প্রহরায় ছিল কর্ণদেব। অগ্নিকুণ্ড থেকে একটা জ্বলন্ত কাঠ ছুঁড়ে ব্যাঘ্রকে বিতাড়িত করতে চাইল সে। তুচ্ছ মানুষের এমন স্পর্ধা দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে সগর্জনে কর্ণদেবকে আক্রমণ করল শার্দুল। গর্জন শুনে সকলেরই ঘুম ভেঙে গেল। এতগুলো মানুষের আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ব্যাঘ্র রণে ভঙ্গ দিল। পাছে সে ফিরে এসে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে সচেষ্ট হয়, সেই ভয়ে রাতটা সকলে জেগেই কাটিয়ে দিল।
আর একদিন একটা পাহাড়ের উপর দিয়ে পথ চলার সময়ে বল্লভের সামনে এগিয়ে এল বিরাট এক ভল্লুক! খুব সম্ভব, বল্লভের বপু দেখে সে তাকে মল্লযোদ্ধা বলে বুঝে নিয়েছিল, আর সেইজন্যেই মল্লযুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে পিছনের দুই পায়ে দাঁড়িয়ে বল্লভকে আলিঙ্গন করতে উদ্যত হয়েছিল। কিন্তু ভল্লুকের নখর-ভয়াল থাবার আলিঙ্গন আর ভয়ংকর দাঁতের বিপজ্জনক সান্নিধ্য বল্লভের পছন্দ হল না- সে তার প্রকাণ্ড কুঠার তুলে সজোরে আঘাত হানল। দৈবক্রমে আঘাতটা মাথার উপর সোজাসুজি পড়ে নি, একটা কান উড়িয়ে দিয়ে মাথার চামড়ার কিছু অংশ ছিঁড়ে নিয়ে গেল কুঠার-ফলক। কাপুরুষ মানুষের বর্বর আচরণে ক্ষুণ্ণ হয়ে চিৎকার করতে করতে ভল্লুক স্থান ত্যাগ করল তিরবেগে।
এই ধরনের বিপদ-আপদ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ মাথায় করে অভিযাত্রীরা যখন দশটা দিন আর দশটা রাত্রি পার করে দিয়েছে, সেইসময় একাদশ দিবসের মধ্যাহ্নে শশক ঘোষণা করল, তারা অভীষ্ট স্থানের খুব কাছেই এসে পড়েছে।
সংবাদ শুনে সকলেই উৎফুল্ল। বল্লভের আনন্দ সবচেয়ে বেশি। কারণ, ঠিক সেই সময়েই তাদের দৃষ্টিগোচর হল তিনটি হরিণ এবং শূল্য মৃগমাংসের কল্পনায় বল্লভের ক্ষুধার্ত জঠর হয়ে উঠল আরও বেশি ক্ষুধার্ত!
অভিযাত্রীরা যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেই জায়গাটা ছিল ঘন লতাগুল্ম আর বৃক্ষের ছায়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন। সম্মুখে উন্মুক্ত প্রান্তরের বুকে বিচরণ করতে করতে মহানন্দে তৃণ ভক্ষণ করছিল তিনটি হরিণ। প্রান্তরের উপর দিয়ে হেঁটে গেলে হরিণরা আততায়ীদের দেখতে পেয়ে পালিয়ে যাবে- তাই ভূমিপৃষ্ঠে অর্ধশায়িত অবস্থায় জানু আর হাতের উপর ভর দিয়ে অগ্রসর হল শায়ন ও শশক। কর্ণদেব, পরন্তপ ও বল্লভমৃগয়া সম্পর্কে অনভিজ্ঞ, তাই তারা যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।
শৃঙ্গধারী পুরুষ হরিণটির দিকেই নিবদ্ধ ছিল শিকারিদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। হরিণী ও হরিণ শাবককে তারা বধ্য মনে করেনি। জানু আর হাতে ভর করে অগ্রসর হতে হতে কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা হরিণদের নিকটবর্তী হল– হরিণরা তখনও বিপদের আভাস পায়নি। আচম্বিতে টঙ্কারধ্বনি তুলে একসঙ্গে বাণ বর্ষণ করল দুটি ধনুক। পরক্ষণেই তিরবিদ্ধ পুরুষ হরিণটি মাটির ওপর ছিটকে পড়ে মৃত্যুযাতনায় ছটফট করতে লাগল। হরিণী ও হরিণশাবক দ্রুতবেগে ছুটে পশ্চাৎবর্তী অরণ্যের গর্ভে আত্মগোপন করল।
আসন্ন ভোজের সম্ভাবনায় উৎফুল্ল বল্লভ প্রচণ্ড উল্লাসে সিংহনাদ করে উঠল– তারপরই ঝড়ের মতো ছুটল ভূপতিত শিকারের দিকে…
হঠাৎ শায়নের মুখের দিকে তাকিয়ে বল্লভ গতি সংবরণ করল। তার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছে, হাত তুলে দক্ষিণ দিক দেখিয়ে সে যেন কিছু বলার চেষ্টা করল। নির্দিষ্ট দিকে ফিরতেই বল্লভের নির্ভীক অন্তরেও জাগল আতঙ্কের শিহরন
দক্ষিণ দিকে অরণ্য ভেদ করে আত্মপ্রকাশ করেছে প্রকাণ্ড হস্তী, এবং দ্রুতবেগে এগিয়ে আসছে বল্লভকে লক্ষ্য করে! বল্লভের চিৎকারেই সে আকৃষ্ট হয়েছে সন্দেহ নেই।
মুহূর্তে পিছন ফিরে বল্লভ ছুটল। পরন্তপ ও কর্ণদেব সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেইখানেই সে পৌঁছতে চাইছিল। ওখানে কেবল তার বন্ধুরাই নেই, ওখানে রয়েছে নিবিড় অরণ্যের অপেক্ষাকৃত নিরাপদ আশ্রয়। উন্মুক্ত প্রান্তরের উপর ক্ষিপ্ত হস্তীর কবল থেকে আত্মরক্ষা করা অসম্ভব। অসংখ্য মহীরুহ আর ঘন উদ্ভিদের আবরণে আচ্ছন্ন অরণ্যের গর্ভে আত্মগোপন করে হয়তো গজরাজকে ফাঁকি দেওয়া যায়
প্রাণপণে ছুটল বল্লভ পশ্চাত্বর্তী অরণ্যের অভিমুখে…
ছুটছে বল্লভ। পিছনে বৃংহণশব্দে অরণ্যকে মুখরিত করে ছুটছে মত্ত হস্তীও। শায়ন যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখান থেকে ধাবমান হস্তীর পশ্চাৎভাগ ছাড়া দেহের অন্যান্য অংশ চোখে পড়ে না– অত দূর থেকে ক্রোধে ক্ষিপ্ত হস্তীর নিতম্বে বা পিছনের পায়ে বাণাঘাত করে তার গতিরোধ করা যাবে না বুঝে শায়ন ধনুর্বান নিয়ে হস্তীর পশ্চাদ্ধাবন করল– উদ্দেশ্য, যদি কাছাকাছি এসে দানবের মর্মস্থানে শরনিক্ষেপ করা যায়।
কিন্তু পিছন থেকে দৌড়ে ধাবমান হস্তীর নিকটস্থ হওয়া মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। শায়ন দেখল তার সঙ্গে হস্তীর দুরত্ব ক্রমশ বর্ধিত হচ্ছে এবং বল্লভের সঙ্গে হস্তীর দুরত্ব হ্রাস পাচ্ছে মুহূর্তে মুহূর্তে বল্লভের অপমৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে শায়ন হতাশ হৃদয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, আর ঠিক সেই সময়ে তার চোখে পড়ল এক আশ্চর্য দৃশ্য—