বল্লভ বলল, পরন্তপ! আমার একটি দুর্বলতার কথা তোমার জেনে রাখা ভালো। আমি যুদ্ধ করতে পারি, যে-কোনো বিপদের সম্মুখীন হতে পারি নির্ভয়ে কিন্তু ক্ষুধার যাতনা আদৌ সহ্য করতে পারি না। আমি এখন অত্যন্ত ক্ষুধার্ত। কাল সন্ধ্যা থেকে এখন পর্যন্ত আমি অভুক্ত। কিছু খাদ্য না পেলে আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়।
কর্ণদেব বলল, আমিও অত্যন্ত ক্ষুধার্ত।
শায়ন বলল, আমার অবস্থাও তোমারই মতো।
পরন্তপ বিপন্ন হয়ে বলল, আমারও ক্ষুধার উদ্রেক হয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে খাদ্য কোথায় পাব? কিয়ৎ পরিমাণে শূল্য মেষমাংস এবং আম, কলা প্রভৃতি কিছু ফল আমার ঘোড়ার পিঠে একটি বস্ত্রের ভিতর নিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু পলাতক অশ্বের সঙ্গে সেগুলিও অন্তর্ধান করেছে। এখন নিকটস্থ অরণ্যে কিছু ফলমূল পাওয়া যায় কি না, সেই চেষ্টাই করো।
বল্লভ বলল, আমি ভীষণ ক্ষুধার্ত। ফলের সন্ধানে অরণ্যে ছুটোছুটি করতে পারব না। আর ফলাহারে আমার প্রচণ্ড ক্ষুধা তৃপ্ত হবে বলে মনে হয় না।
শায়ন ও কর্ণদেব কথা বলল না। কিন্তু তাদের মুখ দেখে মনে হল অরণ্যে প্রবেশ করে ফলাহারের প্রস্তাব তাদের মনঃপুত হয় নি।
পরন্তপ বিব্রতভাবে এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করতে লাগল, যদি ফলভারে সমৃদ্ধ কোনো বৃক্ষ দৈবাৎ চোখে পড়ে এই আশায়।
তোমরা খাদ্যের জন্য বৃথা চিন্তা করছ, খাদ্য তো কাছেই আছে, শশক বলল, বরং পানীয় জলের জন্য একটু কষ্ট হতে পারে। গিরিপথের ধারে একস্থানে বৃষ্টির জল জমে আছে দেখেছি। অবশ্য এতগুলো লোকের ভালোভাবে তৃষ্ণা-নিবারণ করার মতো যথেষ্ট পরিমাণ জল বোধহয় ওখানে হবে না। তবে নিকটবর্তী অরণ্যে নিশ্চয়ই জলের সন্ধান পাওয়া যাবে। আমি জানি, কাছেই একটা নদী আছে।
বল্লভ বলল, জলের সংবাদ শুনে বিশেষ আশ্বস্ত হলাম না। জলপান করে তো ক্ষুধা শান্ত হবে না। আহার্য কোথায়?
শশক বলল, দগ্ধ মাংসেই ক্ষুন্নিবৃত্তি করা যাবে। সেজন্য চিন্তা কিসের?
চারটি কণ্ঠ একসঙ্গে বলে উঠল, মাংস পেলে তো দগ্ধ করব। মাংস কোথায়?
শশক বলল, এতগুলো নেকড়ের মৃতদেহ থাকতে মাংসের ভাবনা কি?
কর্ণদেব বিস্মিতস্বরে বলল, নেকড়ের মাংস? তা কি খাওয়া যায়?
পরন্তপ বলল, অনার্যরা নেকড়ের মাংস খায় শুনেছি। কিন্তু কোনো আর্য-সন্তান কখনো নেকড়ের মাংস ভক্ষণ করেছে কি না জানি না। আমার মনে হয় নেকড়ের মাংস আর্যপুরুষের গ্রহণযোগ্য নয়। শায়ন! তুমি কি বলে?
শায়ন স্খলিতস্বরে বলল, আমি নিজে কখনও ওই মাংস ভক্ষণ করি নি। তবে অনার্যরা যে নেকড়ের মাংস খায় সেকথা সত্য।
শশক বলল, আমি একবার বনমধ্যে অত্যন্ত ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিলাম। হরিণ, বরাহ, প্রভৃতি কোনো পশু তখন আমার চোখে পড়েনি। হঠাৎ একটি নেকড়ে আমার দৃষ্টিগোচর হল। তৎক্ষণাৎ তির নিক্ষেপ করে নেকড়েটাকে বধ করলাম। সেই নেকড়ের মাংস অগ্নিদগ্ধ করে ক্ষুধা নিবারণ করলাম। নিতান্ত মন্দ লাগে নি। অন্তত অখাদ্য বলে তো মনে হয়নি। এই মুহূর্তে আমিও তোমাদের মতোই ক্ষুধার্ত। একটি নেকড়েকে দগ্ধ করে আমি ক্ষুন্নিবৃত্তি করব। তোমাদের রুচি না হয়, অভুক্ত থাকো।
পাহাড়ের তলায় একটি তিরবিদ্ধ নেকড়ের মৃতদেহ লক্ষ্য করে শশক অগ্রসর হল।
উপবিষ্ট অবস্থা থেকে একলম্ফে দণ্ডায়মান হয়ে বল্লভ বলল, আমার রুচি আছে। আমিও নেকড়ের মাংস খাব।
সঙ্গীদের দিকে না তাকিয়ে বল্লভ পাহাড় থেকে নামতে শুরু করল।
শায়ন, কর্ণদেব ও পরন্তপ অর্থপূর্ণভাবে দৃষ্টি বিনিময় করল, তারপর তারাও নিঃশব্দে সঙ্গী দুজনকে অনুসরণ করল…
দগ্ধ মাংস চর্বন করতে করতে পরন্তপ জানাল নেকড়ের মাংসের স্বাদ তার খুব খারাপ লাগছে না!
শশক নীরবে অগ্নিকুণ্ড থেকে একটুকরো মাংস তুলে নিল। শায়ন, কর্ণদেব ও বল্লভ সোৎসাহে জানাল নেকড়ের মাংস সম্পর্কে পরন্তপের সঙ্গে তারা একমত।
.
১৭. অভাবিত বিপত্তি
অতিবাহিত হয়েছে দশটি দিন, দশটি রাত্রি। মাথার উপর অগ্নিবর্ষণ করেছে প্রচণ্ড মধ্যাহ্ন-সূর্য, এসেছে পার্বত্য অঞ্চলের হিমশীতল রাত্রি; পথিমধ্যে একদিন সগর্জনে আবির্ভূত হয়েছে প্রচণ্ড ঝঞ্জাবর্ত; পাঁচটি দুর্ধর্ষ মানুষ তবুও এগিয়ে চলেছে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে অটল চরণে!
অরণ্যও তাদের পথে বাধা সৃষ্টি করেছে বারংবার। কন্টকময় বনভুমি তাদের পা আর দেহকে করে দিয়েছে রক্তাক্ত। পাহাড় থেকে নামতে গিয়ে কর্ণদেবের পা এমন মচকে গেছে যে, দুদিন সে আর মাটিতে পা ফেলতে পারে নি। কিন্তু অভিযান স্থগিত থাকেনি মুহূর্তের জন্যও। প্রথমে বল্লভ, তারপর শশক কর্ণদেবকে স্কন্ধে বহন করেছে এবং সেই অবস্থায়ই অতিক্রম করেছে। ক্রোশের পর ক্রোশ। দিবাভাগে প্রখর রবিরশ্মি আর রজনীতে বনভূমির শীতার্ত বায়ুর আলিঙ্গনে পরন্তপের অবস্থা বেশ কাহিল- যদিও সেকথা সে কিছুতেই স্বীকার করতে চায় না। বনের ফল অধিকাংশই অখাদ্য, তাই মৃগয়ালব্ধ পশুমাংসই অভিযাত্রীদের একমাত্র আহার্য। সব সময় ভালো শিকার পাওয়া যায় না, তাই বল্লভের উদর প্রায়ই ক্ষুধার্ত থাকে। এমন ভাবে শূন্য উদরে ক্রোশের পর ক্রোশ চলা যে তার স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর, সেই তথ্য ক্রমাগতই সঙ্গীদের কর্ণকুহরে পরিবেশন করতে করতে অনবরত পা চার্লিয়ে এগিয়ে চলেছে বল্লভ– কারণ, ক্লান্ত হলেও থামলে চলবে না। শুধু দুটি মানুষ কোনো অভিযোগ না করে নিঃশব্দে অক্লান্তপদে অতিক্রম করছে দুর্গম পথ, তাদের মুখে কিংবা দেহে একমুহূর্তের জন্যেও ক্লান্তি বা অবসাদের চিহ্ন দেখা যায় না– শশক ও শায়ন!