কর্ণদেবের মুখ ক্রোধে আরক্ত হল। অপাঙ্গে সেইদিকে তাকিয়ে পরন্তপ বলল, শশক! বয়স কম বলে কর্ণদেবকে অবজ্ঞা করো না। অসিচালনায় ওর সমকক্ষ যোদ্ধা খুব কমই আছে।
সায় দিয়ে শায়ন বলল, সত্য কথা। আমি ওকে অসিচালনা করতে দেখেছি। পরন্তপের উক্তি আদৌ অত্যুক্তি নয়।
বল্লভ বলল, কর্ণদেবকে আমি তরবারি ব্যবহার করতে দেখিনি। কিন্তু আমার চোখের সামনে ও বামহস্তে ছুরিকা ধরে তিনটি লৌহদস্তানাধারী দুর্বৃত্তকে পর্যুদস্ত করেছে এবং কিঞ্জল নামে এক অসিধারী দুর্বৃত্তকে বামহস্তের ওই ছুরির সাহায্যেই দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরাস্ত করেছে। বামহস্তে ছুরিকা নিয়ে যে এমন অসাধারণ ক্ষমতার পরিচয় দিতে পারে, দক্ষিণহস্তে তরবারি গ্রহণ করলে, সে কি করতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
বিস্ময়-বিস্ফারিত দৃষ্টিতে কর্ণদেবকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে শশক বলল, তোমার নাম। কর্ণদেব?… তুমি সার্থকনামা সন্দেহ নেই। যা শুনলাম তা যদি সত্য হয়, তবে তমি মহাভারতে কর্ণের মতোই নিপুণ যোদ্ধা। কিন্তু আমি তোমার ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করিনি। এদের মুখে তোমার বিক্রমের পরিচয় পাওয়ার আগেই আমি ধনুর্বিদ্যায় তোমরা ক্ষমতা স্বচক্ষে দর্শন করেছি- তোমার নিক্ষিপ্ত বাণ নির্ভুল নিশানায় অনেকগুলো নেকড়ের ভবলীলা সাঙ্গ করে দিয়েছে। কিন্তু এত অল্প বয়সে তোমাকে দস্যুদলে যোগ দিতে দেখে আমি বিরক্ত হয়েছি। তোমার বলবিক্রমে সন্দিগ্ধ হয়ে তোমাকে বালক সম্বোধন করিনি।
কর্ণদেব বলল, ওই সম্বোধনটি আমি অত্যন্ত অপছন্দ করি। পুনরায় আমাকে বালক সম্বোধনে অভিহিত করলে আমি তোমাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাতে বাধ্য হব শশক! আমি তোমার ক্ষমতা দেখেছি কিন্তু অসিহস্তে তোমার বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে আমি ভয় পাই না। আরও একটা কথা তুমি আমাকে দুস্যবৃত্তি করতে দেখনি, শুধু দস্যুর সাহচর্যে আছি বলেই আমাকে দস্যু মনে করলে কেন? তিরন্দাজ শায়ন এবং মহাবলী বল্লভও আজ পরন্তপের সঙ্গী তারাও কি দস্যু?
শাশক বলল, কর্ণদেব! সে সম্বোধন তুমি পছন্দ করো না, সেই সম্বোধন তুমি ভবিষ্যতে কখনো আমার মুখে শুনতে পাবে না। তোমাকে দস্যু মনে করে যদি ভুল করে থাকি, তাহলে বলব দস্যুর সহচরকে সহজ বুদ্ধিতে দস্যু বলেই মনে করা স্বাভাবিক। তবে তোমাদের যোগাযোগ অতি অদ্ভুত- যোদ্ধা, সন্ন্যাসী ও প্রিয়দর্শন এক কিশোরের সঙ্গে দস্যু দলপতির যোগাযোগ চিন্তা করা যায় না।
কর্ণদেব বলল, পৃথিবীতে তোমার অচিন্ত্যনীয় অনেক কিছুই ঘটতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলছি- গেরুয়াধারী বল্লভ গেরুয়া ধারণ করলেও সন্ন্যাসগ্রহণ করেনি।
সবিস্ময়ে শশক বলল, এত অল্প সময়ের মধ্যে বারংবার এমনভাবে চমকিত হওয়ার মতো তথ্য এর আগে কখনো সংগ্রহ করতে পারিনি। বল্লভ! একথা সত্য? তুমি সন্ন্যাসী নও?
বল্লভ হেসে বলল, না। শ্বেতবস্ত্র শীঘ্রই মলিন হয়। বারংবার বস্ত্র ধৌত করার পরিশ্রমে আমি অনিচ্ছুক, তাই গেরুয়াকে অঙ্গে ধারণ করেছি। অন্যান্য রং আমি পছন্দ করি না।
কর্ণদেব বলল, দস্যুবৃত্তির স্বপক্ষে ও বিপক্ষে বিস্তর যুক্তি থাকতে পারে; ব্যক্তিবিশেষের পেশা বা বৃত্তি দেখে তার সঙ্গীর স্বভাব-চরিত্রের বিচার কার অনুচিত। জানো তো–উত্তম নির্ভয়ে চলে অধমের সাথে, তিনিই মধ্যম যিনি থাকেন তফাতে।
শশক ভ্রূকুঞ্চিত করে বলল, একই দিনের মধ্যে এতবার চমকে চমকে উঠলে আমার দুর্বল হৃৎপিণ্ডের গতি হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে। কর্ণদেব! তোমার কথা শুনে বুঝতে পারছি তুমি শুধু অস্ত্রচালনাতেই শিক্ষালাভ করোনি, পুঁথিপত্র নিয়ে দস্তুরমতো বিদ্যাভ্যাসও করেছ।
পরন্তপ বলল, কর্ণদেব আমার প্রিয় সহচর বটে, কিন্তু দস্যু নয়। ও ব্রাহ্মণ-সন্তান। অস্ত্র-অভ্যাস করার আগে দীর্ঘকাল বিদ্যাভ্যাস করেছে। ওর কথা এখন থাক। তোমার কথা বলল। তুমি আমাদের দলের প্রত্যেকটি মানুষেরই পরিচয় পেয়েছ, কিন্তু তোমার নাম ছাড়া আর কিছুই আমরা জানি না। বলো তুমি কোথায় থাকো? কি উপায়ে জীবিকানির্বাহ করো? আত্মীয়-স্বজন কে কোথায় আছে?
দূর আকাশে দৃষ্টি মেলে দাস স্বরে শশক বলল, সমগ্র আর্যাবর্তে আমার বাসস্থান। যত্রতত্র ঘুরে বেড়াই, কোনো নির্দিষ্ট স্থানে স্থায়ীভাবে বাস করি না। জীবিকানির্বাহের জন্য কোনো বিশেষ, বৃত্তি গ্রহণ করি নি। প্রয়োজনে তরবারি ও ধনুর্বাণ ব্যবহার করি বটে। আর আত্মীয়স্বজন? আমি যাদের সাহচর্যে আসি তারাই আত্মার সঙ্গী, আমার আপনার জন অর্থাৎ স্বজন। কেবলমাত্র রক্তের বন্ধনে আমি বিশ্বাসী নই।
পরন্তপ বলল, শশক! তুমি পরিহাস করছ। বুঝলাম, সঠিক পরিচয় দিতে তুমি সম্মত নও। বেশ, আমরা শুধু তোমার নামটি জেনেই খুশি থাকার চেষ্টা করব।
শশক বলল, আমি পরিহাস করি নি। সত্য কথাই বলেছি। কিন্তু শল্যের মৃতদেহ যে পড়ে আছে, সেকথা ভুলে যেও না। মৃতের সকার করতে হবে।
পরন্তপ বলল, অবশ্যই। উপর থেকে মৃতদেহ বহন করে নীচে আনা খুবই কষ্টকর। সেই চেষ্টা করব না। পর্বতশিখরেই মৃতদেহের সৎকার করব। অদূরবর্তী অরণ্যে বৃক্ষের অভাব নেই এবং বন্ধুবর বল্লভও কুঠার হাতে নিকটেই বর্তমান অতএব অরণ্য থেকে কাঠ সংগ্রহ করে উপরে গিয়ে সৎকারকার্য সমাধা করতে বিশেষ অসুবিধা হবে না।