জিজ্ঞাসু নেত্রে কিশোর তার ভূতপূর্ব প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে দৃষ্টিপাত করল।
আমি দীর্ঘকাল শস্ত্রচর্চা করেছি। বিশেষত ধনুর্বাণ ও অসি আমার প্রিয় অস্ত্র, আগন্তুক বলল, আমি জোর করে বলতে পারি উপযুক্ত গুরুর সাহায্য না পেলে এমন ভাবে তরবারিকে আয়ত্ত করা যায় না। শিষ্যের যদি এই নমুনা হয় তো গুরুর হাতের অসি নিশ্চয়ই জীবন্ত সর্পের মতো প্রাণঘাতী।… বলো কিশোর, কে তোমার গুরু? কি তার নাম? তোমার নামটিও জানতে চাই।
প্রতিপক্ষ যখন খাপ থেকে তলোয়ার টেনে নিয়েছিল তখনই অসির বিদ্যুৎ সঞ্চালন দেখে কিশোর বুঝেছিল এই মানুষটি বড়ো সহজ নয়। প্রাণসংশয়ের সম্ভাবনা আছে জেনেই সে তরবারিতে হাত দিয়েছিল। প্রতিপক্ষের প্রশংসা ও বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারে এখন সে সহজ হয়ে উঠছিল, মুখের কঠিন রেখাগুলো মিলিয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে কিন্তু হঠাৎ ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ আসতেই কঠিন রেখাগুলি আবার ফিরে এল মুখের ওপর, চোয়াল হল আড়ষ্ট, দুই চোখে দেখা দিল রোষের স্তিমিত অগ্নি!
নীরস স্বরে সে বলল, নাম-ধামের প্রয়োজন কি? পথের দেখা পথেই শেষ। এই তরবারির ওপর আমার অধিকার আছে কি না এইটুকুই শুধু আমার জিজ্ঞাস্য।
আগন্তুক কয়েক মুহূর্ত বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, তারপর তার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল- যোদ্ধৃসুলভ নিস্পৃহ গাম্ভীর্যে কঠিন হয়ে উঠল অধরের রেখা, চোখের দৃষ্টিতে ভেসে উঠল অবরুদ্ধ ক্রোধের আভাস।
ওই অসি তোমার, আগন্তুক শুষ্কস্বরে বলল, অস্ত্রচালনায় তোমার দক্ষতা প্রমাণিত। কিন্তু তোমার অন্তঃকরণ বড়ো নয়। আর্যযোদ্ধার উদার মনোভাব তোমার নেই। আমার পরিচয় দিলে তুমি জানতে পারতে কতখানি সম্মান তুমি পেয়েছিলে, তবে
হঠাৎ আগন্তুকের কণ্ঠস্বরের দারুণ ক্রোধে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, অবরুদ্ধ ক্রোধ ফেটে পড়ল তীব্র ভর্ৎসনায়, তবে জেনে রাখো, যে যোদ্ধা গুরুর কাছে উপযুক্ত ব্যক্তিকে নিয়ে যেতে ভয় পায়, সে কখনো আদর্শ শস্ত্রবিদ হতে পারে না। নিজের সম্বন্ধে তার সংশয় আছে, অপরের। সম্পর্কে ঈর্ষা ও আতঙ্ক। আমি তোমার গুরুর কাছে অস্ত্রচালনা শিক্ষা করতে চাই নি। চেয়েছিলাম এক গুণীকে সম্মান দিতে, আর
ক্রোধের উচ্ছ্বাসে তার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এল, আত্মসংবরণ করে সে কণ্ঠকে সংযত করল, ভিতরের ক্রোধ তবু চাপা রইল না, বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছিলাম নখর-ভয়াল এক ব্যাঘ্ৰশাবকের দিকে। অরণ্যের পশু হিংস্র বীরত্বের অধিকারী, আর্যযোদ্ধার উদার মনোভাব সে কোথায় পাবে?.. ধিক!
ক্ষণমধ্যে জনতার বেষ্টনী ভেঙে আগন্তুক প্রস্থান করল। সে যদি একবার পিছন ফিরে কিশোরের মুখের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করত তাহলে দেখত ক্রোধের পরিবর্তে সেই মুখের ওপর নেমে এসেছে বিষাদের করুণ ছায়া!
.
০৩. ‘অর্থ অনর্থের মূল!’
কিশোরের চমক ভাঙল পসারির কণ্ঠস্বরে, আশ্চর্য কৌশল! তোমার বয়স অল্প বটে, কিন্তু অসিচালনায় তুমি সিদ্ধহস্ত।
কিশোর খানিকক্ষণ নিষ্পলক শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পসারির মুখের দিকে; তারপর চিন্তার জগৎ ছেড়ে তার মন ফিরে এল বাস্তব পৃথিবীর বুকে একবার মুখের ওপর হাত বুলিয়ে নিয়ে সে সহজভাবে তাকাল পসারির দিকে, কি বলছ?
-বলছি আশ্চর্য তোমার কৌশল। এই বয়সেই অসিচালনায় তুমি সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছ।
একবার হাতের তরবারির দিকে দৃষ্টিপাত করে কিশোর জিজ্ঞাসা করল, পসারি! এই অসির জন্যে তোমায় কত দিতে হবে?
–কিছু না। এই অসি তোমায় আমি উপহার দিলাম।
কিশোরের ললাটে জাগল কুঞ্চনরেখা, কণ্ঠস্বরে ফুটল বিরক্তির আভাস, উপহার! তোমার উপহার আমি গ্রহণ করব কেন?
পসারি বিনীত হাস্যে দন্তবিকাশ করল, গুণীকে সম্মান প্রদর্শন করলে উপহার গ্রহণে গুণীর বাধা নেই। এই তরবারি দিয়ে আমি গুণীকে সংবর্ধনা জানাচ্ছি।
ভ্রূকুটির রেখা সরে ললাট মসৃণ হল, তরবারি বারেক নিরীক্ষণ করে কিশোর সেটিকে কোষবদ্ধ করল। তারপর হাসিমুখে পসারির দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল, আমি একটি লোকের সন্ধান করছি। নাম জয়দ্রথা বলতে পারো, কোথায় তাকে পাওয়া যাবে?
–মল্লবীর জয়দ্রথ?
–হ্যাঁ।
–তার গৃহের সন্ধান বলতে পারব না। তবে এই অঞ্চলে প্রত্যহ অপরাহ্নে সে ক্রীড়া প্রদর্শন করে, বিনিময়ে নাগরিকদের কাছ থেকে পায় পারিতোষিকস্বরূপ কিছু অর্থ। একটু খুঁজে দেখ। ভাগ্য প্রসন্ন হলে আজও দেখা হতে পারে।
জনতা সরে গিয়েছিল। যারা রোমাঞ্চকর একটি দ্বৈরথ যুদ্ধ দেখার জন্য উদগ্রীব ছিল, তারা সবাই উধাও। কয়েকজন অতিকৌতূহলী ব্যক্তি কিশোরের দিকে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছি। সম্ভবত কিশোরের আকৃতি-প্রকৃতি নিয়ে তারা গবেষণায় ব্যস্ত।
অকস্মাৎ সমবেতমণ্ডলীর ভিতর থেকে এক ব্যক্তি এগিয়ে এল, তুমি জয়দ্রথ নামে মল্লযোদ্ধার সাক্ষাৎ পেতে চাও?
-হ্যাঁ। কোথায় তিনি?
নিকটেই। একটু আগে পূর্বদিকের ওই বিস্তৃত রাজপথের একপাশে দৃশ্যমান রক্তবর্ণ অট্টালিকার পিছন দিকের পথে জয়দ্রথ ক্রীড়াপ্রদর্শনের উদ্যোগ করছিল। আমি আগে অনেকদিন ওর খেলা দেখেছি, তাই দাঁড়াইনি। তুমি যদি ওখানে গিয়ে জয়দ্রথের সাক্ষাৎ পেতে চাও তাহলে আমার সঙ্গে আসতে পারো।
অজস্র ধন্যবাদ, কিশোর এগিয়ে গেল বক্তার দিকে, চলো, কোথায় যেতে হবে।
নির্দিষ্ট স্থানে রক্তবর্ণ অট্টালিকার পাশে দাঁড়িয়ে দূরবর্তী এক জনতার দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করে কিশোরের সঙ্গী বলল, ওই যে লোকগুলো দাঁড়িয়ে আছে, ওখানে গেলেই জয়দ্রথের সাক্ষাৎ পাবে। তুমি যাও। আমি ওর খেলা বহুদিন দেখেছি।