জনতা নির্বাক। কিন্তু প্রতীক্ষায় অধীর। আতঙ্ক ও কৌতূহলজড়িত দৃষ্টি মেলে তারা এক রোমাঞ্চকর নাটকের রক্তাক্ত অভিনয় দেখার জন্য উদগ্রীব।
হঠাৎ বাধা দিল পসারি, না, না, আমার দোকানের সামনে রক্তপাত করবেন না।
নির্বোধ বণিক, আগন্তুক ধমকে উঠল, আমি শিশুহত্যা করি না। তবে শিশুর দঃসাহস ও স্পর্ধা দেখলে তাকে শাসন করি বটে।… যাও! ওই যে ব্যক্তি অনতিদূরে ফলের পসরা সাজিয়ে বসে আছে, ওর কাছ থেকে তিনটি আম নিয়ে এস।
আম! আম কি হবে?
জনতার ভিতর জাগল বিস্ময়ের গুঞ্জন ধ্বনি, কিন্তু কেউ প্রশ্ন করতে সাহসী হল না– অস্ত্রধারী পুরুষের মেজাজকে বিশ্বাস নেই। নবাগত পুরুষ যে অসিচালনায় দক্ষ সে বিষয়ে কারো সন্দেহ ছিল না। একটু আগে সে যখন খাপ থেকে তলোয়ার টেনে এনেছিল, তখন তার ক্ষিপ্রতা দেখে সবাই বুঝেছিল ওই ব্যক্তি মরণখেলার এক অভ্যস্ত খেলোয়াড়।
এসব লোক উত্তেজিত হলে তার সামনে বেশি বাক্যব্যয় করা সুবুদ্ধির কাজ নয় বিবেচনা করে গুঞ্জরিত জনতা ধীর ধীরে নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
বস্ত্রের ভিতর থেকে কয়েকটি তাম্রমুদ্রা নিয়ে আমের দাম চুকিয়ে দিল আগন্তুক। তারপর আম তিনটিকে পাশাপাশি সাজিয়ে রাখল দোকানের কাষ্ঠাধারের উপর।
হঠাৎ অস্ফুট আর্তনাদ করে পিছিয়ে গেল পসারি– তার নাকের সামনে আলোকস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে আগন্তুকের অসি সবেগে নেমে গেল কাষ্ঠাধারে রক্ষিত আম তিনটির দিকে।
একটি আমকে খণ্ডিত করে অসি উঠল, আবার নামল সারিবদ্ধ আমের উপর বিদ্যুৎবেগে।
তোমরা সবাই দেখ, উর্ধে তরবারি তুলে আগন্তুক চেঁচিয়ে উঠল, মাঝখানের আমটি অটুট আছে। কিন্তু দুপাশের দুটি আমকে ঠিক সমান মাপে দুভাগ করে কেটেছি।
সাধু! সাধু!
বিস্মিত জনতা প্রবল হর্ষধ্বনি করে অভিনন্দন জানাল। কাজটা কঠিন বটে। তিনটি আম প্রায় গায়ে গায়ে লাগিয়ে রাখা হয়েছে, মাঝে ফাঁক খুব কম। মাঝখানের আমে একটু আঁচড় না লাগিয়ে দুপাশের দুটি আমকে সমান মাপে কাটা খুবই কঠিন। আরও আশ্চর্যের বিষয় যে, আগন্তুক লক্ষ্য স্থির করে কোপ মারে নি- তার আসি চার্লিত হয়েছে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো উপযুপরি দুবার।
জনতা সবিস্ময়ে স্বীকার করল হা লোকটার ক্ষমতা আছে বটে।
আগন্তুক এইবার কিশোর প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে তাকাল, বালক! কাজটা খুব সহজ মনে হচ্ছে কি?
কিশোর হাসল, এটা কি খুব কঠিন কাজ? তুমি বিদ্রূপ করে আমায় বালক বললেও আমি প্রকৃতপক্ষে বালক নই। কিন্তু যখন আমি সত্যি বালক ছিলাম, তখনও এমন সহজ একটা কাজ করে প্রশংসা কুড়াতে চেষ্টা করতাম না। অবশ্য ব্যক্তিবিশেষের কাছে এই কাজ খুব কঠিন বলে মনে হতে হবে। অসিচালনার পাঠে যারা অ, আ, ক, খ পড়ছে এই পরীক্ষা তাদেরই উপযুক্ত বটে। বীরযোদ্ধাকে এই ধরনের পরীক্ষা দিতে বললে তাকে অপমান করা হয়, বাক্যবীরদের কথা অবশ্য স্বতন্ত্র।
জনতার ভিতর থেকে একজন মন্তব্য করল, বৎস! এইবার তুমি মাঝের আমটিকে সমান দুভাগে কাটো। আমরা দেখে নয়ন সার্থক করি।
কিশোরের প্রতিদ্বন্দ্বী তিক্তস্বরে বলল, হ্যাঁ, সমান দুইভাগে তো কাটবেই। ওই সঙ্গে একথাও মনে রেখ, তৃতীয় আমটি কাটার সময়ে পাশের আম দুটিতে একটুও আঁচড় লাগতে পারবে না।
তথাস্তু–কিশোর সবেগে অসিচালনা করল।
মুহূর্তের স্তব্ধতা। পরক্ষণেই তুমুল অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল জনতা। কিশোরের প্রতিপক্ষের হাসির শব্দটাই বড়ো বেশি স্পষ্ট।
কোনোমতে হাসি থামিয়ে আগন্তুক বলল, খব তো বড়ো বড়ো কথা বলছিলে। কিন্তু এটা কি হল? আমি তো নিখুঁতভাবে দুটি আমকেই সমান দুভাগে কেটেছি– আর তোমার অসি তৃতীয় আমটিকে স্পর্শও করল না।
কৌতুক-তরল স্বরে কিশোর বলল, কে বলেছে আমার অসি আমটিকে স্পর্শ করেনি?
তুমি কি উন্মাদ নাকি, চোখে দেখতে পাও না? বিস্মিত নেত্রে আবার কিশোরের মুখের পানে তাকিয়ে জনতার দিকে ফিরল আগন্তুক, ভাই সব, তোমরাই বলো মাঝের আমটিকে ওর তরবারি কি স্পর্শ করেছে? অসি লাগলে ফল তৎক্ষণাৎ ছিন্ন হত।
জনতা গর্জন করে উঠল, ঠিক ঠিক! আমরা দেখেছি অসি আমকে স্পর্শ করেনি। আঘাত লাগলে আম নিশ্চয়ই ছিন্ন হত।
কিশোর কোনো কথা না বলে এগিয়ে এসে মাঝের আমটিতে হাত দিল। সঙ্গে সঙ্গে তার আঙুলের মধ্যে উঠে এল আমের কর্তিত অর্ধাংশ!
স্তম্ভিত জনতার দিকে দৃষ্টিপাত করে কিশোর সহাস্যে বলল, আমিও সমান মাপেই কেটেছি। তোমরা ওই দুটি কাটা আমের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারো ওদের মতো আমারটাও ঠিক সমান দুই ভাগে কাটা পড়েছে। প্রভেদ এই যে, আমার আম দ্বিখণ্ডিত হয়েও ছিটকে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েনি।
জনতা স্তম্ভিত, স্তব্ধ!
কিশোরের প্রতিদ্বন্দ্বীর অবস্থাও তথৈবচ।
সত্যি অকল্পনীয়। আমটিকে নিখুঁতভাবে সমান দুইভাগে বিভক্ত করে দিয়েছে কিশোরের তরবারি! কিন্তু আঘাতের ওজন এমনই পরিমিত যে, খণ্ডিত অংশ দুটি ছিটকে পড়ার অবকাশ পায় নি। অতি সূক্ষ্ম রেখায় বিদীর্ণ ফলের দুই অংশ রসসিক্ত হয়ে পরস্পরের সঙ্গে আটকে থেকে দর্শককে বিভ্রান্ত করেছে মনে হয়েছে আমটি অক্ষত ও অটুট অবস্থাতেই বিরাজমান। তরবারি বুঝি আমকে স্পর্শও করেনি।
স্তব্ধতা ভঙ্গ করল কিশোরের প্রতিদ্বন্দ্বী, এমন চমৎকার হাতের কাজ আমি কখনো দেখি নি। অপূর্ব! অদ্ভুত! আমি আমার বাক্য প্রত্যাহার করছি। তুমি যদি অস্ত্রধারণের যোগ্য না হও, তবে সমগ্র আর্যাবর্তে অস্ত্রধারণের যোগ্য পুরুষ একটিও নেই.. কিন্তু কিশোর, আমার একটি প্রশ্ন আছে।