অপরাহ্ন। শ্রাবস্তীর রাজপথে আনন্দ-উচ্ছল নাগরিকদের স্বচ্ছন্দ গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করলে এবং দোকানে দোকানে ক্রেতা ও বিক্রেতার আলাপ, কলহ ও হাস্যধ্বনি শ্রবণ করলে যে কোনো নবাগত মানুষের ধারণা হবে রুদ্রদমনের রাজ্যে বিশেষ করে রাজধানীতে সুখ ও শান্তি বিরাজ করছে সর্বতোভাবে, এখানে অশান্তি উৎপাতের চিহ্ন অনুপস্থিত।
জনতার মধ্যে পথ করে চলতে চলতে যে কিশোরটি উৎসুক নেত্রে এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করছিল, তা মনেও এমনি ভাবনারই ছায়াপাত ঘটেছিল। বলাই বাহুল্য, কিশোর-পথচারী নগরীতে নবাগত। তার ভাবভঙ্গি দেখলে মনে হয় সে কোনো ব্যক্তির সন্ধান করছে।
হঠাৎ পার্শ্ববর্তী এক বিপণি থেকে পসারির উচ্চ কণ্ঠস্বর ভেসে এল কিশোরের কানে, আসুন! আসুন! অতি অল্পমূল্যে ভালো ভালো সামগ্রী বিক্রয় হচ্ছে। এই সুযোগ হেলায় হারাবেন না। আসুন! আসুন!
কিশোর বিপণির দিকে চাইল। বিভিন্ন সামগ্রীর মধ্যে চর্মরঙ্গুতে আবদ্ধ একটি নগ্ন তরবারির দিকে চোখ পড়তেই অলস দৃষ্টি তীব্র আগ্রহে জ্বলে উঠল- সে এগিয়ে গেল দ্রুত পদে…
পসারি তখনও হাঁক দিচ্ছে, আসুন! আসুন! দেখুন, এই মৃভাণ্ড উৎকৃষ্ট সুরার আধার। ঘোর গ্রীষ্মে এই পাত্রে আসব হিমশতিল থাকবে। এই যে রজতশুভ্র কুম্ভ দেখছেন
বাধা দিয়ে কিশোর বলল, ওই তরবারির মূল্য কত?
পসারি একবার কিশোরের মুখের দিকে তাকাল, ধূর্ত হাসির রেখা জাগল তার অধর-ওষ্ঠে, মধুঝরা গলায় সে বলল, অতি উৎকৃষ্ট অসি। নাম মাত্র দাম। এই নিন।
তরবারির বন্ধন মোচন করে সে কিশোরের দিকে এগিয়ে দিল। কিশোর হাত বাড়াল, অধীরকণ্ঠে প্রশ্ন করল, নামমাত্র দামটি কত?
হে, হে, বিগলিত হাস্যে পসারি জানাল, মাত্র দুটি রজত মুদ্রা।
দুটি রজত মুদ্রা? কিশোরের ভ্রু কুঞ্চিত হল, বড়ো বেশি দাম।
আদৌ নয়, পসারি বলল, হাতে নিয়ে দেখুন কিশোর যোদ্ধার উপযুক্ত অস্ত্র।
কিশোর সাগ্রহে এইবার হাত বাড়াল। কিন্তু সে তরবারি স্পর্শ করার আগেই এক ব্যক্তি দ্রুতপদে এগিয়ে এসে পসারির হাত থেকে অসি টেনে নিল।
পসারির মুখ থেকে একটা অস্ফুট ধ্বনি বেরিয়ে এল, কিন্তু সে কোনো মন্তব্য করল না। কিশোর ক্রেতা সবিস্ময়ে বলে উঠল, এ কি!
লোকটি কোনোদিকে দৃকপাত করল না, আপনমনে অসি পরীক্ষা করতে করতে বলল, এই তরবারি ভালো ইস্পাতে তৈরি সন্দেহ নেই। তবে এটি বালকের খেলার বস্তু নয়।
ক্রুদ্ধস্বরে কিশোর বলল, আমি বালক নই। কিন্তু তুমি হঠাৎ পসারির হাত থেকে অসি ছিনিয়ে নিলে কেন?
আগন্তুক বলল, পসারি তোমার হাতে অসি তুলে দিচ্ছিল, কারণ সে বিক্রেতা। অসির বিনিময়ে অর্থ পেলেই সে খুশি অস্ত্রধারণে ইচ্ছুক ক্রেতার যোগ্যতা নির্ণয় করার ক্ষমতা বা ইচ্ছা তার নেই। কিন্তু আমি শস্ত্রবিদ। অস্ত্রধারীর যোগ্যতা বিচারের ক্ষমতা আমার আছে। তুমি অস্ত্রধারণে অযোগ্য, তাই অসি ছিনিয়ে নিয়েছি। এই অসি উৎকৃষ্ট বটে। আমি এই অসি ক্রয় করব।
কিশোরের ওষ্ঠাধর হিংস্র হাস্যে বিভক্ত হল, আমাকে অস্ত্রধারণে অযোগ্য মনে করার কারণ?
শ্লেষতিক্ত স্বরে উত্তর এল, যে বালক কোমরে শূন্যগর্ভ অসিকোষ রাখে, অস্ত্রধারণের যোগ্যতা তার নেই। নিশ্চয়ই কোনো ব্যক্তি কোষ থেকে অসি ছিনিয়ে নিয়েছে। ভালোই করেছে দুর্বলের অঙ্গে শোভাবৃদ্ধি করার জন্য তরবারির অবস্থান বাঞ্ছনীয় নয়।
এর মধ্যে দুজনকে ঘিরে একটি ছোটোখাটো জনতার সমাবেশ ঘটেছে। আগস্তুকের কথা শুনে সকলেই সকৌতুকে কিশোরের কটিদেশের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করল- সত্য বটে; কিশোরের বামদিকে কটিতে আবদ্ধ চর্মবন্ধনীর সঙ্গে ঝুলছে একটি শূন্যগর্ভ অসিকোষ! দক্ষিণপার্শ্বে অবস্থিত অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র আধারটি অবশ্য শূন্য নয়– সেখানে খাপের ওপর দৃশ্যমান হাতলটি সুদীর্ঘ এক ছুরিকার অস্তিত্ব জানিয়ে দিচ্ছে।
কিশোর নীরবে একবার আগন্তুকের কোমরের উপর চোখ বুলিয়ে নিল, তারপর শুষ্কস্বরে বলল, আমার অসিকোষ শূন্য বলেই আমি এই অসি ক্রয় করতে চাই। তোমার কোমরে দেখছি একটি তরবারি ঝুলছে। অনর্থক তুমি আমাকে বঞ্চিত করতে চাইছ কেন? ..
আগন্তুক বলল, আগেই বলেছি আমি শস্ত্রবিদ। বিশেষত অসি আমার প্রিয় অস্ত্র। এই অসি অত্যুত্তম ইস্পাতে নির্মিত। সেইজন্যেই এই অসি আমি রাখব। অর্থাৎ অধিকন্তু ন দোষায়।
কিশোরের দুই চোখ জ্বলে উঠল, তুমি কি জানোনা একটি খাপে দুটি তরবারি প্রবেশ করতে পারে না?… বর্বর! অধিক কথায় কাজ কি? যদি সাহস থাকে পসারির অসি আমার হাতে দিয়ে তোমার নিজস্ব অসি গ্রহণ করে। এখনই বুঝিয়ে দেব অস্ত্রধারণে আমার অধিকার তোমার চাইতে বেশি ছাড়া কম নয়।
অতি উত্তম প্রস্তাব, আগস্তুক সহাস্যে বলল, এই নাও তোমার অস্ত্র।
কিশোর হাত বাড়িয়ে তরবারি গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গেই নবাগত মানুষটি বিদ্যুৎবেগে তার অসি কোষমুক্ত করল।
জনতা সভয়ে ছিটকে দূরে সরে গেল। এসময় প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছাকাছি থাকা নিরাপদ নয়।
আগন্তুক হেসে বলল, বালক! এইবার তোমার অস্ত্রধারণের যোগ্যতা পরীক্ষা করব।
কিশোর হাসল। তার প্রতিদ্বন্দ্বীর হাসিতে ছিল কৌতুক ও ব্যঙ্গের স্পর্শ, কিন্তু কিশোরের স্মিত অধরে ফুটল দস্তুর শ্বাপদ-হিংসা!
দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পরস্পরের মাথা থেকে পা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নিল। তারা যেন চোখ দিয়ে প্রতিপক্ষের ক্ষমতা মেপে নিচ্ছে।