–স্তব্ধ হও। তুমি কোনোদিনই কর্তব্য পালনে সমর্থ হবে না। নির্লজ্জ। আজ থেকে তিনদিনের মধ্যে যদি তোমার কথা না রাখতে পারো তবে তোমাকে কুকুরের ন্যায় গৃহ থেকে বিতাড়িত করবে!
সাবধান! পিছন থেকে ভেসে এল অজ্ঞাত কণ্ঠে সতর্কবাণী, বল্লভ সম্মানিত নাগরিক। তাকে পুনরায় অপমান করলে আমি তোমার জিহ্বা ছেদন করব।
খর্বাকায় ব্যক্তি সভয়ে তাকিয়ে দেখল তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে এক কিশোর। কিশোরের কটিবন্ধে তরবারি ও ছুরিকা, সায়াহ্নের অন্ধকারেও দৃষ্টিগোচর হয়।
বল্লভের ভয়ার্ত মুখে ফুটল আনন্দের আভাস, কর্ণদেব! তুমি! তুমি কি পুরস্কার গ্রহণ করতে যাওনি?
কর্ণদেব বলল, না। আমি আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্যই ছুটে আসছি। লোকমুখে আপনার গন্তব্য পথের নির্দেশ গ্রহণ করে পদচালনা করেছি অতি দ্রুতবেগে। ভাগ্যক্রমে পথেই আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। নচেৎ, অনর্থক আপনার গৃহের অনুসন্ধানে বিলম্ব হতো।
খর্বাকার ব্যক্তি শ্যেন দৃষ্টিতে কর্ণদেবকে নিরীক্ষণ করছিল, এবার সে কথা বলল, বল্লভ! আজকাল বুঝি অস্ত্রধারী দুর্বত্তরা তোমার শিষ্যত্ব গ্রহণ করছে?
কর্ণদেব ক্রুদ্ধস্বরে বলল, আমি অস্ত্রধারী বটে, তবে দুর্বৃত্ত নই। বল্লভের শিষ্যত্ব আমি গ্রহণ করি নি, ভবিষ্যতে তার শিষ্য হওয়ার বাসনাও নেই… কিন্তু বল্লভ! আপনার ন্যায় মহাবল পুরুষকে এই দ্বিপদ কৃকলাস অপমান করে কোন সাহসে?
বল্লভ বলল, আমার ভগ্নীর বিবাহ উপলক্ষে আমার পিতা উত্তানপাদ নামক এই কুসীদজীবীর কাছে বসতবাটী বন্ধক রেখে তিন শত স্বর্ণমুদ্রা ঋণস্বরূপ গ্রহণ করেছিলেন। পিতা ছিলেন সওদাগর। তার বাণিজ্যপোত সেই সময়ে দূর দেশে অবস্থান করছিল। হঠাৎ ভালো সম্বন্ধ স্থির হয়ে গেল বলে পিতা তৎক্ষণাৎ কন্যার বিবাহ দিলেন। ঘরে যা অর্থ ছিল তার পরিমাণ কম ছিল না, কিন্তু অত্যধিক আড়ম্বর করার জন্য সঞ্চিত অর্থে টান পড়ল। কয়েক মাসের মধ্যেই। বাণিজ্যপোতগুলি ফিরে আসার কথা তাই পিতা ঋণগ্রহণে ইতস্তত করেননি। পিতার শরীর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, মাতৃহারা কন্যার বিবাহের জন্য তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ঋণগ্রহণ করে তাড়াতাড়ি বিবাহ দেওয়ার সেটাও একটা কারণ। কিন্তু ভগ্নীর বিবাহের পরই ঘটল ভাগ্য-বিপর্যয়। কিছুদিন পরেই দুঃসংবাদ এল- ঝড়ের মুখে বাণিজ্যপোতগুলি ধ্বংস হয়ে গেছে। পিতা তার সমস্ত অর্থ ওই বাণিজ্যে নিয়োগ করেছিলেন, অতএব বাণিজ্যপোতগুলি বিনষ্ট হওয়ায় আমরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলাম। ভগ্নস্বাস্থ্য ও ভগ্নহৃদয় নিয়ে পিতা সেই বৎসরেই দেহত্যাগ করলেন। কিন্তু কুসীদজীবী উত্তানপাদের ঋণ রয়ে গেল। আর সেই ঋণ শোধ করার জন্য রইলাম আমি। তিনশত স্বর্ণমুদ্রা দুই বৎসরের মধ্যেই সুদে-আসলে তিনসহস্রে পরিণত হয়েছে। আগামী তিনদিনের মধ্যে ঋণ শোধ করতে না পারলে রাজদ্বারে অভিযোগ জানিয়ে উত্তানপাদ আমার পৈতৃক গৃহ অধিকার করবে। আমি অধমর্ণ– বাধ্য হয়ে উত্তমর্ণের কটুবাক্য সহ্য কবছি।
কর্ণদেব কুসীদজীবীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল, উত্তানপাদ! কাল প্রভাতে বল্লভ তোমার গৃহে তিন সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পৌঁছে দেবেন এবং চুক্তিনামাটি ফিরিয়ে নেবেন। এখন তুমি অন্যত্র গমন করো।
দুজনেই স্তম্ভিত!
সহসা ব্যঙ্গভরে হেসে উঠল উত্তানপাদ, তিন সহস্র স্বর্ণমুদ্রা তুমি দেবে? হাঃহাঃহাঃ! তোমার কাছে তিনটি স্বর্ণমুদ্রাও আছে কিনা সন্দেহ!
নির্বোধ কুসীদজীবী, কর্ণদেব রূঢ়স্বরে বলল, আমার কটিবন্ধে রক্ষিত একটিমাত্র রত্নের উপযুক্ত মূল্য তোমার কোষাগারে আছে কিনা সন্দেহ!
কটিবন্ধের গোপন স্থান থেকে কর্ণদেবের ডান হাতের মুঠিতে আবির্ভূত হল একটি ক্ষুদ্র বস্তু সন্ধ্যারম্লান অন্ধকারে সেই প্রস্তরবৎ বস্তুটি অজস্র আলোক স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে জ্বল জ্বল করে উঠল!
উত্তানপাদ সাগ্রহে হাত বাড়িয়ে দিল, দেখি! দেখি! একবার আমার হাতে দাও।
–দেখ। দেখে নয়ন সার্থক করো।
এ তো দেখছি মহামূল্য বৈদূর্যমণি! এই বস্তুটি তুমি কোথায় পেলে?
অবান্তর প্রশ্ন। এখন অনুগ্রহ করে মণি আমার হাতে ফিরিয়ে দাও।
উত্তানপাদের ওষ্ঠাধরে জাগল ধূর্ত হাসির রেখা, সে মণিটি কর্ণদেবের হাতে দিয়ে বলে উঠল, মণি তুমি কোথায় পেয়েছ এই প্রশ্ন আমার মুখে নিশ্চয়ই অবান্তর! কিন্তু নগরকোটালের কাছে এক নগণ্য কিশোরের কটিবন্ধে মহামূল্য বৈদূর্যমণির অবস্থানের প্রশ্ন বোধহয় নিতান্ত অবান্তর প্রসঙ্গ বলে বিবেচিত হবে না।
কর্ণদেবের ভ্রুকুঞ্চিত হল, বটে?
–তবে কাল প্রভাতে তিন সহস্রের পরিবর্তে যদি ছয় সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পাই, তাহলে এই সংবাদ নগরকোটালের কর্ণকুহরে প্রবেশ করবে না।
-ওহে উত্তানপাদ, শ্রবণ করো। আমি যেখান থেকে এই মণি পেয়েছি, সেইখানে এইপ্রকার অজস্র মণিমাণিক্য আছে। তোমাকে সন্ধান বলে দিচ্ছি- ইচ্ছা করলে তুমি সেই গোপন স্থান থেকে ওইসব রত্ন আরোহণ করতে পারো, অথবা নগরকোটালকে ওই স্থানের সন্ধান দিতে পারো।
–এইবার তুমি সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছ। ওহে কিশোর, আমি জানি বৈধ উপায়ে এই মণি তোমার হস্তগত হয় নি। যাই হোক, আমি যদি লাভবান হই, তাহলে নগরকোটালের কাছে গিয়ে তোমাকে বিপন্ন করব না। বলো কোথায় আছে ওইসব মূল্যবান মণিমাণিক্য।