রুদ্রদমনের গুপ্তচর বিভাগ অতিশয় সক্রিয়। কিন্তু এক অভিনব পদ্ধতিতে দলকে পরিচার্লিত করে ধূর্ত পরন্তপ গুপ্তচরদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিল।
কোনো সূত্রে বিশেষ কোনো ব্যক্তির উপর সন্দেহ উপস্থিত হলেই গুপ্তচর তার উপর নজর রাখতে থাকে। কিন্তু দীর্ঘকাল পর্যবেক্ষণ চার্লিয়েও সন্দেহভাজন ব্যক্তির কোনো সন্দেহজনক কার্যকলাপ তারা আবিষ্কার করতে পারে না। কারণ আগেই বলেছি- পরন্তপের নিয়ম অনুসারে একই দল বা একই ব্যক্তি কখনো পর পর দু-বার লুণ্ঠন অভিযানে অংশগ্রহণের সুযোগ পায় না। সন্দেহভাজন ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের উপর নজর রাখতে রাখতে গুপ্তচর যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে, সেই সময় হঠাৎ আর এক নতুন জায়গা থেকে আসে পরন্তপ পরিচার্লিত দস্যুবাহিনীর হানা দেওয়ার সংবাদ। যাদের সন্দেহ করা হয়েছিল তাদের নির্দোষ ভেবে অন্যদিকে ছোটে গুপ্তচর, আর চক্রবৎ পদ্ধতিতে পূর্বোক্ত সন্দেহভাজনদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ স্থাপন করে দস্যু পরন্তপ।
এই অভিনব পদ্ধতির জন্যেই রুদ্রদমনের গুপ্তচর-চক্র এবং রক্ষীবাহিনী পরন্তপের সন্ধান পায় না। গ্রামে বা নগরে হানা দেওয়ার সময়ে দৈবাৎ কখনো টহলদারি রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে যখন পরন্তপের সংঘর্ষ ঘটেছে এবং দুই-একটি আহত দস্যু ধরা পড়েছে, তখনই উল্লসিত হয়ে উঠেছে দেশের মানুষ আশা করেছে বন্দি দস্যুদের মুখ থেকেই দস্যু দলপতির যথাযথ পরিচয় ও বাসস্থান জানা যাবে। কিন্তু তাদের আশা সফল হয়নি। রক্ষীদল বন্দি দস্যদের প্রচণ্ড প্রহারে জর্জরিত করেছে, উৎকোচের লোভ দেখিয়েছে কোতোয়াল- কিন্তু সব চেষ্টাই বিফল হয়েছে। শেষ পর্যন্ত। বন্দিরা জানিয়েছে উষ্ণীষের আবরণ খুলে পরন্তপ তাদের মুখ দেখায়নি কখনো। সে কোথায় থাকে তাও তারা জানে না। পরন্তপের অন্তরঙ্গ যে কয়েকটি অনুচর সকলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে, একমাত্র তারাই পরন্তপের খোলা মুখের চেহারা দেখার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু তাদের সন্ধান করা অসম্ভব। যে লোক একটা দলের সঙ্গে যোগাযোগ করে, সে আর কয়েক বৎসরের মধ্যে ওই দলের সামনে আসে না। আসে নতুন মানুষ। সেখানেও দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে একই লোকের কাছ ঘুরে আসার অভিনব পদ্ধতি প্রয়োগ করে ধূর্ত দস্যু সকলকেই অন্ধকারে রেখেছে। ফলে কয়েকজন দস্যকে গ্রেপ্তার করা সত্ত্বেও রক্ষীবাহিনী দলপতির সন্ধান পায় না।
অতএব, গ্রামে গ্রামে, নগরে নগরে, নগরের উপকণ্ঠে সর্বত্রই চলতে থাকে তাণ্ডবলীলা। দস্যুর অত্যাচারে দেশের লোক যখন অত্যন্ত বিচলিত, সেই সময় হঠাৎ একদিন রাজদরবার থেকে ঘোষণা শোনা যায়- ধরা দাও পরন্তপ, নচেৎ মৃত্যু অনিবার্য।
আশ্চর্য কাণ্ড! ভেরী ও ঢক্কানাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজাদেশ ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দস্যু অন্তর্ধান করল! সেই সঙ্গে অন্তর্হিত হলেন মহারাজ রুদ্রদমন!
.
০২. কিশোর যোদ্ধা
প্রায় সাত মাস হল মহারাজ রুদ্রদমন নিরুদ্দেশ। প্রজারা অবশ্য সেইজন্য বিশেষ উদ্বিগ্ন নয়। তারা জানে মহারাজ মাঝে মাঝে নিখোঁজ হয়ে যান, আবার ফিরে আসেন। মহারাজের অবর্তমানে রাজকার্যের বিঘ্ন হয় না, মন্ত্রী মহাশয় সেই সময়ে রাজকার্য পরিচালনা করেন নিপুণ ভাবে।
না, মহারাজকে নিয়ে প্রজারা চিন্তিত নয়। খুব বেশিদিন রাজা নিখোঁজ থাকলে হয়তো চিন্তার কারণ ঘটত, কিন্তু এক বৎসর রাজ্যে অনুপস্থিত হওয়া রাজা রুদ্রদমনের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। একবার নিখোঁজ হলে তিন থেকে ছয় মাসের আগে মহারাজ সচরাচর ফিরে আসেন না। একাদিক্রমে তিন বছর নিরুদ্দেশ থাকার ঘটনাও ঘটে গেছে আগে। অতএব সাত মাসের অনুপস্থিতি প্রজাবর্গকে বিশেষ বিচলিত করেনি।
পাশাপাশি অন্যান্য রাজ্যের নৃপতিগণ অবশ্য এভাবে নিরুদ্দেশ হলে রাজ্যে হই চই পড়ত। কিন্তু রুদ্রদমনের রাজ্যে রাজার অনুপস্থিতি নিতান্তই স্বাভাবিক। কেন তিনি চলে যান, বা কোথায় যান, এ-বিষয়ে প্রচুর জল্পনা-কল্পনা করেও কেউ স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি তাই এখন আর কেউ এ-বিষয়ে মাথা ঘামায় না।
সমগ্র রাজ্যে একটিমাত্র মানুষ মহারাজের নিরুদ্দেশ যাত্রার কার্যকারণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত। মানুষটির নাম মহাসত্ত্ব- রুদ্রদমনের রাজ্য শ্রাবস্তীর মন্ত্রী।
মহাসত্ত্ব স্পষ্টভাষী। নিরুদ্দেশ-যাত্রার বিপক্ষে ভালো ভালো যুক্তি সহযোগে তার কঠোর মন্তব্যগুলি মহারাজের কানে তুলতে তিনি দ্বিধাবোধ করেননি। কিন্তু রাজনীতি, সমাজনীতি, মানবতাবোধ প্রভৃতি অত্যন্ত জটিল বিষয়বস্তুর সঙ্গে বিবিধ তথ্য ও তত্ত্ব জড়িত করে এক সুদীর্ঘ বক্তৃতার প্রচণ্ড স্রোতে মহারাজ মন্ত্রীবরকে একেবারে ধরাশায়ী করে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন। একই ঘটনার বারংবার পুনরাবৃত্তির ফলে অধুনা মহাসত্ত্ব আর মহারাজের নিরুদ্দেশ যাত্রার প্রস্তাবে আপত্তি করেন না; রুদ্রদমনের নির্দেশ অনুসারে তার অনুপস্থিতির সময়ে গুরুদায়িত্ব পালন করেন বিনা প্রতিবাদে, কিন্তু মন্ত্রীবরের অন্তরে যুগপৎ উদ্বেগ ও ক্রোধের সঞ্চার হয়।
সম্প্রতি মহাসত্ত্ব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু ক্রুদ্ধ হলেও রুদ্রদমনের হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার কারণটা আমাদের খুলে বলবেন না মহাসত্ত্ব। সময়বিশেষে তার কর্ণ হয় বধির এবং জিহ্বা হয় মৌন। বর্তমানে মহাসত্ত্ব উপরিউক্ত অবস্থাপ্রাপ্ত হয়েছেন। সুতরাং বোবা মহাসত্ত্বকে কথা কওয়ানোর দুঃসাধ্য চেষ্টা না করে আমরা বরং রুদ্রদমনের রাজ্যে কিছুক্ষণ বেড়িয়ে আসি…