তীরবেগে ছুটতে ছুটতে পার্শ্ববর্তী সঙ্গীকে উদ্দেশ্য করে কিঞ্জল বলল, জল্লাদ! ভণ্ডটা আমাদের ভীরু কাপুরুষ বলছে যে!
গতিবেগ একটুও না কমিয়ে জল্লাদ বলল, বলতে দাও হে, বলতে দাও। কিঞ্জল! মন্দ লোকের কথায় কখনো কান দিতে নেই।
নগরবাসীরা জল্লাদ ও নেকড়ের-বাহিনীর বহু অত্যাচার দেখেছে, অস্ত্রচালনায় তাদের দক্ষতার কথাও তাদের অবিদিত নয়-কিন্তু তারা যে দ্রুতধাবনে বেগবান অশ্বকেও লজ্জা দিতে পারে এই সত্যটি নাগরিকের জানা ছিল না।
দেখতে দেখতে পথের মোড় ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল কিঞ্জল ও জল্লাদ। তাদের পিছনে তাড়া করে ছুটল জনতার হর্ষধ্বনি। সবাই বুঝল বেশ কিছুদিনের মধ্যে নেকড়ে-বাহিনী আর নগরীর বুকে আত্মপ্রকাশ করতে চাইবে না।
অকস্মাৎ কলভবর্মার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল রত্নাকরের দিকে গোলমালের মধ্যে জনতার ভিতর আত্মগোপন করে সে সরে পড়ার চেষ্টা করছে! তৎক্ষণাৎ ঘোড়া চার্লিয়ে কলভবর্মা তার পাশে এসে দাঁড়ালেন, তারপর কঠিন স্বরে বললেন, দাঁড়াও রত্নাকর, কোথায় যাচ্ছ? যুদ্ধে তোমার নেকড়ের দল পরাজিত। নিঃশব্দে পলায়ন করে তুমি আইনকে ফাঁকি দিতে পারবে না। মল্লযোদ্ধাকে প্রতিশ্রুত অর্থ না দিলে আমি তোমাকে গ্রেপ্তার করব। বিচারে তোমার কারাদণ্ড অনিবার্য।
তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে জয়দ্রথ বলল, কেতোয়াল মহাশয়। আপনি যদি ভেবে থাকেন রত্নাকর পলায়নের চেষ্টা করছে, তাহলে আপনি ভুল করেছেন। রত্নাকর অতি দ্রুত গৃহে গমন করছিল প্রতিশ্রুত সহস্র স্বর্ণমুদ্রা এনে আমার হাতে সমর্পণ করার জন্য তাই নয় কি রত্নাকর?
বিব্রত বণিক ব্ৰস্তস্বরে বলে উঠল, যথার্থ! যথার্থ! হাস্যসংবরণ করে কলবর্মা বললেন, বটে! বটে! তাহলে আমিও রত্নাকর আর জয়দ্রথের সঙ্গী হব। আমার সম্মুখে রত্নাকর বণিক মল্লযোদ্ধা জয়দ্রথের হাতে দুই সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দিলে সুখী হব। রত্নাকর! এই ব্যবস্থা কেমন?
ইয়ে-হ্যাঁ-অর্থাৎ, উত্তম ব্যবস্থা।
জয়দ্রথ বলল, কোতোয়াল মহাশয়! সহস্র স্বর্ণমুদ্রার কিয়দংশ কর্ণদেব নামে এই কিশোর এবং গেরুয়াধারীর প্রাপ্য। ওরা না থাকলে আমি– আরে গেরুয়াধারী কোথায়?
জয়দ্রথ! আমি অর্থের প্রত্যাশী নই,কর্ণদেব বলে উঠল, কিন্তু গেরুয়াধারী কোথায় অদৃশ্য হলেন?
জনতার ভিতর থেকে এক বলিষ্ঠদর্শন বৃষস্কন্ধ পুরুষ আত্মপ্রকাশ করল, আমি দেখেছি উনি নগরীর পূর্বদিকে গমন করেছেন। ওইদিকেই ওঁর বাসগৃহ। খুব সম্ভব পুরস্কার গ্রহণে অনিচ্ছুক বলেই বল্লভ নিঃশব্দে স্থানত্যাগ করেছেন। বল্লভ স্বভাবত প্রচারবিমুখ।
কর্ণদেব বলল, ওঁর নাম বল্লভ? তুমি ওঁকে জানো দেখছি। আমি ওই মহাশক্তিধর সন্ন্যাসীর সঙ্গে কথা বলতে চাই। কোথায় তাকে পাব?
বলিষ্ঠ ব্যক্তি বলল, বল্লভ গেরুয়াধারণ করলেও সন্ন্যাসী নন। তবে তার কিছু শিষ্য আছে। স্বল্পসংখ্যক ওই শিষ্যদের মধ্যে আমি অন্যতম। কিন্তু বল্লভের পরিচয় তার মুখ থেকেই পাওয়া ভালো। এই নগরীর পূর্বপ্রান্তে সন্ধান করলে তাকে পাবে। দ্রুত পদচালনা করলে পথেও সাক্ষাৎ হতে পারে।
বক্তার পেশিবদ্ধ বিপুল দেহ নিরীক্ষণ করে কর্ণদেব মনে মনে বলল, বল্লভ সন্ন্যাসী হয়েও কেন গৈরিকধারণ করেন জানি না, তবে তার কার্যকলাপ দেখে আর শিষ্যের বপুদংশন করে মনে হয় আত্মার উন্নতির চাইতে মাংসপেশীর উন্নতিসাধন করতেই বল্লভ সমধিক তৎপর।
সে বল্লভের নির্দেশ অনুসারে নগরীর পূর্বদিক লক্ষ্য করে পদচালনা করল।
কর্ণদেব! পিছন থেকে জয়দ্রথের আহ্বান ভেসে এল, কোথায় চললে? পুরস্কারের অর্থে তোমারও অংশ আছে যে!
কর্ণদেব দুর থেকেই চিৎকার করে বলল, জয়দ্রথ! আমি অর্থ চাই না। পুরস্কারের অর্থ তুমি একাই ভোগ করো।
দ্রুতপদে বল্লভের উদ্দেশে নির্দিষ্ট দিকে অগ্রসর হল কর্ণদেব। তার চিন্তার জগতে তখন ঝড় উঠেছে অসাধারণ মানুষ ওই গেরুয়াধারী বল্লভ। যে ভাবেই হোক আজ তাঁর সঙ্গে দেখা করতেই হবে। সময় আর বেশি নেই। কিন্তু পুরস্কারের অর্থে বল্লভের বীতস্পৃহা দেখে ভয় হচ্ছে তিনি হয়তো আমার প্রস্তাবে সম্মত হবেন না। হয়তো তিনি ধনবান, সেক্ষেত্রে তাকে আমি প্রলুব্ধ করতে পারব কি?… তবে কি আবার আমাকে ফিরে আসতে হবে জয়দ্রথের কাছে?… কিন্তু জয়দ্রথ আর বল্লভ? ফুঃ!… বল্লভের কাছে জয়দ্রথ হচ্ছে মাতঙ্গের কাছে পতঙ্গের মতোই তুচ্ছ। শাস্ত্রে অবশ্য মধুর অভাবে গুড় দেওয়ার উপদেশ প্রচলিত আছে… দেখা যাক।
.
০৭. বিপন্ন বল্লভ
নগরীর পূর্বদিকে একটি পথ ধরে এগিয়ে চলছিল বল্লভ। তার মনে তখন অজস্র প্রশ্ন- জনতার ভিতর থেকে সরে তত পড়লাম… কিন্তু কে ওই কর্ণদেব? বয়সে কিশোর, অথচ অস্ত্র চালনায় সিদ্ধহস্ত!… অপরিচিত মল্লযোদ্ধা জয়দ্রথের সন্ধান করছিল কেন ওই রহস্যময় কিশোর? কি তার উদ্দেশ্য?
আচম্বিতে তার পিছন থেকে ভেসে এল এক তীব্র কণ্ঠস্বর, বল্লভ! ওহে বল্লভ!
বল্লভ চমকে ফিরে দাঁড়াল। তাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে এল শীর্ণকায় এক খর্বাকার ব্যক্তি।
বল্লভের সামনে এসে খর্বকায় ব্যক্তি বলল, এই যে বল্লভ! কোথায় চলেছ?
–গৃহে।
-বেশ, বেশ। কিন্তু আর তিনদিন পরেই সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। আশা করি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তুমি কর্তব্য পালন করবে?
–আমি- আমি– অনুগ্রহপূর্বক আমাকে আরও পক্ষকাল সময় দিন। আমি নিশ্চয় করে বলছি–