–সন্ন্যাসী! নগরবাসী ওই নেকড়ের দলকে ভয় করে। তাদের মধ্যে কেউ আপনার হাতে অস্ত্র তুলে দিতে সাহস করবে না।
জয়দ্রথ! তোমার মস্তিষ্ককে অকারণে ঘর্মাক্ত কোরো না। স্তব্ধ হও।
এইবার এগিয়ে এল কর্ণদেব, মহাশয়! আপনি ক্ষান্ত হন। আমি এই নগরীতে নবাগত, কিন্তু জয়দ্রথ এই নগরের বাসিন্দা নাগরিক-চরিত্র সম্বন্ধে সে অবহিত। সে বলছে এখানে কেউ আপনার হাতে অস্ত্র তুলে দিতে সাহস করবে না। নিরস্ত্র অবস্থায় মহাশক্তিধর হলেও আপনি অস্ত্রধারীর বিরুদ্ধে কি করতে পারেন?… দেখুন, সমবেত জনতার ভিতর থেকে এখন পর্যন্ত একটি মানুষও এগিয়ে এসে আপনার হাতে কোনো অস্ত্র তুলে দিল। অতএব অনুরোধ আপনি ক্ষান্ত হন।
গেরুয়াধারীর ওষ্ঠাধরে হাসির রেখা অধিকতর বিস্তৃত হল, কর্ণদেব! অনর্থক দুশ্চিন্তা ও বাক্যব্যয়ে শক্তিক্ষয় না করে আসন্ন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। আমি কারো কাছে অস্ত্র চাই না। নগরকোটাল অনুমতি দিলে এই রাজপথ থেকেই আমি অস্ত্র সংগ্রহ করব।
কলভবর্মা এতক্ষণ নীরবে কথোপকথন শুনছিলেন, এইবার তিনি মুখ খুললেন, রাজপথ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করবেন…? বুঝেছি, কিন্তু বিপণি থেকে অস্ত্র ক্রয় করার সময় আমি দিতে পারি না।
গেরুয়াধারীর কণ্ঠ অবিচলিত, আমি মুহূর্তের মধ্যে অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারি। আপনি যুদ্ধের অনুমতি দিন।
উদ্যত অসি হস্তে চিৎকার করে উঠল নেকড়ের দল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, যুদ্ধের অনুমতি দিন। কলভবর্মা! আমরা অনর্থক বিলম্ব করতে রাজি নই।
কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ থেকে কলভবর্মা গম্ভীর স্বরে ঘোষণা করলেন, আমি নগরকোটাল কলভবর্মা ঘোষণা করছি-এক থেকে দশ অবধি আমি গণনা করব। ওই সময়ের মধ্যে যদি গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারে তো ভালো, নচেৎ দশ বলার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হবে… এক!
কলভবর্মা! মুহূর্তকাল মুহূর্তকাল অপেক্ষা করুন, গেরুয়াধারী হাঁক দিল, কোনো বিশেষ অস্ত্র সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা আছে কি?
-ধনুর্বাণ ছাড়া যে কোনো অস্ত্রই ব্যবহার করা চলে… দুই! গেরুয়াধারী হঠাৎ পিছন ফিরে রাজপথে দণ্ডায়মান জনতার দিকে এগিয়ে চলল।
কলভবর্মা গুনতে লাগলেন, তিন! চার! পাঁচ! ছয়! জয়দ্রথ প্রশ্ন করল, কর্ণদেব! গেরুয়াধারী রাজপথ থেকে কোন অস্ত্র সংগ্রহ করবে?
কর্ণদেবের ললাটে জাগল কুঞ্চনরেখা, জানি না।
-সাত! আট!
কিঞ্জল ব্যঙ্গভরে বলল, গেরুয়াধারী শুধু ভণ্ড নয়, ও বদ্ধ উন্মাদও বটে!
জল্লাদ বন্ধুর কথায় সায় দিল না, চিন্তিতভাবে বলল, কিন্তু ও কি করতে চায়?… দেখ! ওই যে বৃক্ষের তলায় দণ্ডায়মান জনতা, ওইখানেই এগিয়ে যাচ্ছে গেরুয়াধারী… আরে! ও যে দেখছি বৃক্ষ ধরে টানাটানি করছে।
-নয়। দশ।
কলভবর্মার কণ্ঠে দশ গণনা সম্পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমবেত জনতার কণ্ঠে জাগল কোলাহল-ধ্বনি!
রাজপথে অবস্থিত একটি গাছকে মূলশূদ্ধ টেনে তুলে ফেলেছে গেরুয়াধারী!
আপাতত এই বৃক্ষকেই আমি অস্ত্ররূপে গ্রহণ করলাম, হাত দিয়ে গাছের ডালপালা পরিষ্কার করতে করতে গেরুয়াধারী বলল।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বজ্রমুষ্টির আকর্ষণে ডালপালা আর পাতার রাশি ঝরে পড়ে উৎপাটিত বৃক্ষ এক সুবিশাল দণ্ডের আকার ধারণ করল!
সেই বৃক্ষকে মাথার উপর তুলে সবেগে দুই পাক ঘুরিয়ে গেরুয়াধারী প্রচণ্ড কণ্ঠে যুদ্ধের আহ্বান জানাল, আমি প্রস্তুত। দশ গণনাও শেষ। অতএব হে নেকড়ের দল- রণং দেহি!
কিঞ্জল এক পা পিছিয়ে বলল, জল্লাদ! আমার সঙ্গীরা পলায়ন করছে। আমরা কি করব? ওই বিশাল বৃক্ষ যদি মস্তকে পতিত হয়
জল্লাদ দুই পা পিছিয়ে বলল, তবে মৃত্যু নিশ্চিত!
গেরুয়াধারীর হস্তে বৃক্ষ যমদণ্ডের মতো আন্দোলিত হল, সে আবার হাঁকল, রণং দেহি।
প্রত্যুত্তরে আরও কয়েক পা পিছিয়ে গেল কিঞ্জল ও জল্লাদ। রত্নাকর চেঁচিয়ে উঠল, কিঞ্জল। জল্লাদ! আক্রমণ করো। তোমরা পলায়ন করলে আমাকে সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দণ্ড দিতে হবে।
কর্ণদেব উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, জয়দ্রথ! আমি অসি কোষবদ্ধ করলাম। তুমিও লৌহদণ্ড নামিয়ে রাখতে পারো। বোধহয় বিনাযুদ্ধেই তুমি অর্থলাভ করবে।
জয়দ্রথ বলল, তাই তো মনে হচ্ছে। এই সন্ন্যাসী সাধারণ মানুষ নয়। বলবান বলে গর্ব ছিল, সেই গর্ব আজ চূর্ণ হয়ে গেল। সন্ন্যাসীর তুলনায় আমি নিতান্তই তুচ্ছ।
আবার জাগল রণহুঙ্কার, রণং দেহি!
রণ দেওয়ার বিন্দুমাত্র লক্ষণ না দেখিয়ে জল্লাদ মৃদুস্বরে বলল, কিঞ্জল! আমি রত্নাকর বণিকের বেতনভোগী নই, সুতরাং পালাতে পারি। কিন্তু তোমার পলায়নের উপায় নেই। পলায়ন করলে তোমার প্রভু রত্নাকর ক্রুদ্ধ হবে। কারণ, তাহলে তাকে অর্থদণ্ড দিতে হবে।
গেরুয়াধারীর দিকে চকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিঞ্জল বলল, রত্নাকর বণিকের অর্থের চাইতে আমার প্রাণের মূল্য অনেক বেশি। অন্তত আমার কাছে।
গেরুয়াধারী আর অপেক্ষা করল না।
আমি যুদ্ধ শুরু করছি, বলেই এগিয়ে এসে সেই প্রকাণ্ড বৃক্ষকে লাঠির মতো সবেগে চালনা করল শত্রুর দিকে।
–ওফ!
–হা!
চটপট লাফ মেরে আঘাত এড়িয়ে সরে গেল কিঞ্জল ও জল্লাদ। তারা যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেই জায়গার উপর সশব্দে আছড়ে পড়ল গেরুয়াধারীর গাছ।
একটানে গাছকে আবার তুলে নিয়ে মাথার উপর ঘোরাতে ঘোরাতে গেরুয়াধারী বলল, দ্বিপদ নেকড়ে দেখছি চতুষ্পদের মতোই ক্ষিপ্র! কিন্তু প্রথম আঘাত এড়িয়ে গেলেও দ্বিতীয়বার আমাকে ফাঁকি দিতে পারবে না!… আরে! আরে! তোমরা যুদ্ধ না করেই পলায়ন করছ? ধিক! ভীরু! কাপুরুষ!