বাঘের থাবার মতো প্রকাণ্ড একটা থাবা কর্ণদেবের মুখের উপর পড়ে তাকে স্তব্ধ করে দিল, পরক্ষণেই অসমাপ্ত সমোধন লুফে নিয়ে জয়দ্রথ কর্ণদেবের বাক্য সমাপ্ত করল, নগরকোটাল কলভবর্মা। আমার বন্ধু এতগুলি বীরপুরুষের সমাগমে কিঞ্চিৎ বিহ্বল হয়ে পড়েছে… তাকে কয়েকটা মুহূর্ত সময় দিন.. আচ্ছা… আশা করি এইবার সে সংবিৎ ফিয়ে পেয়েছে।
জয়দ্রথ তার হাত সরিয়ে নিল! এক মুহূর্তের জন্য তার দিকে ক্রুদ্ধ কটাক্ষপাত করে আবার শত্রুর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল কর্ণদেব।
কিঞ্জলের দল কিছুক্ষণের জন্য বিমুঢ় হয়ে পড়েছিল। দলপতির নির্দেশে তারা আবার কর্ণদেব ও জয়দ্রথকে লক্ষ্য করে অগ্রসর হল।
জল্লাদ উত্তেজিত স্বরে বলল, মল্লযোদ্ধা হঠাৎ কর্ণদেবের মুখ চেপে ধরল কেন? কর্ণদেব বিহ্বল হওয়ার পাত্র নয়। নিশ্চয়ই ওদের কোনো গূঢ় অভিসন্ধি আছে! কিঞ্জল! খুব সাবধান! যেন পালাতে না পারে।
কিঞ্জল হাসল, তুমি নিশ্চিত থাকো জল্লাদ! এই মৃত্যুফাঁদ থেকে ওদের আজ নিস্তার নেই।
আচম্বিতে সকলের শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করল কলবর্মার উচ্চকণ্ঠের আদেশ, দাঁড়াও!
–কী! কী!
–নগরকোটাল কলভবর্মা! যুদ্ধ বন্ধ করার অধিকার আপনার নেই।
সমবেত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল আক্রমণোদ্যত দুবৃত্তের দল।
জনতা নীরব।
স্পষ্টই বোঝা যায় তারা এই অসম যুদ্ধের পক্ষপাতী নয়। কলভবর্মা, রত্নাকর বণিকের কর্কশ চিৎকার শোনা গেল, আপনি যুদ্ধ বন্ধ করতে পারেন না। আমরা আপনার বিরুদ্ধে রাজদ্বারে অভিযোগ করব।
জল্লাদ ও কিঞ্জল সমস্বরে চিৎকার করে উঠল, রাজদ্বারে অভিযোগ করলে আপনার কঠিন শাস্তি হবে। কলবর্মা! স্মরণ রাখবেন, আইনের প্রতিনিধি হয়ে আইন ভঙ্গ করলে চরমদণ্ডের বিধানও রয়েছে।
কলভবর্মা বললেন, আমি যুদ্ধ বন্ধ করার আদেশ দিচ্ছি না। সে অধিকার আমার নেই। আমি শুধু তোমাদের কাছে আবেদন জানিয়ে বলছি যে দুটি নির্দোষ মানুষকে–
চুপ করুন, তীব্রস্বরে জল্লাদ বলল, আমরা কোনো আবেদন-নিবেদন শুনতে চাই না। কিঞ্জল! তোমার সঙ্গীরা দাঁড়িয়ে আছে কেন?
জল্লাদ! জলদগম্ভীর স্বরে কলবর্মা বললেন, তোমাকে আমি আজ সতর্ক করে দিচ্ছি। তোমার বহু অন্যায় ও দুষ্কর্মের কথা আমার কানে আসে। যেদিন তোমাকে প্রমাণসহ গ্রেপ্তার করতে পারব, সেইদিন–
বাধা দিয়ে জল্লাদ বলল, সেইদিন যা খুশি করবেন। কিন্তু আজ আপনি যুদ্ধে বাধা দিচ্ছেন কেন?
তারপরই কলভবর্মাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সে কিঞ্জলের দিকে ফিরে চিৎকার করে উঠল, তোমরা দাঁড়িয়ে আছ কেন? সবাই তরবারি হাতে অগ্রসর হও।
আরে না! না! এত ব্যস্ত হলে চলে? একটি উচ্চ কণ্ঠস্বর ভেসে এল পিছন থেকে।
উদ্যত অস্ত্র সংবরণ করে দুই পক্ষই আশ্চর্য হয়ে দেখল সহাস্যবদনে হাত তুলে চিৎকার করছে গেরুয়াধারী, এত ব্যস্ত হলে চলে? আইন অনুসারে আমারও যুদ্ধে যোগ দেওয়ার অধিকার আছে যে! রত্নাকর বণিককে শুন্যে তুলে নিক্ষেপ করার উদ্যোগ করায় আমিও কলহে লিপ্ত হয়ে পড়েছি, একথা ভুললে তো চলবে না।
বিস্ময় বিস্ফারিত নেত্রে কলভবর্মা বলে উঠলেন, আপনি! আপনি যুদ্ধ করবেন?
অবশ্যই, গেরুয়াধারীর মুখে প্রশান্ত হাসি, আইন বলছে কলহে লিপ্ত যে কোনো ব্যক্তি এই যুদ্ধে যোগ দিতে পারে। তাই নয় কি?
কলভবর্মা এমন আশ্চর্য হয়ে গেলেন যে তার মুখে কথা ফুটল না। কিন্তু দুর্বৃত্তদের কণ্ঠে জাগল প্রবল হাস্যধ্বনি।
-ওই স্থূলকায় মেদসর্বস্ব সন্ন্যাসী যুদ্ধ করবে? হাঃ! হাঃ!
হো! হো! হো
–হি! হি হি!
গেরুয়াধারী নির্বিকার মুখে বলল, আপনাদের হাস্যধ্বনি শ্রবণ করে হৃদয়ে বিমল আনন্দলাভ করলাম। কিন্তু কোতোয়াল মহোদয়– আইন অনুসারে আপনি আমাকে যুদ্ধের অনুমতি দিতে বাধ্য। কারণ, এই কলহে আমিও লিপ্ত ছিলাম।
কলভবর্মা বললেন, যোগিবর! আপনি বলবান এবং রসিক পুরুষ সন্দেহ নেই। কিন্তু কেবলমাত্র দৈহিকবল সম্বল করে শাণিত অসির সামনে রসিকতা করা যায় না। আমি আইন অনুযায়ী যুদ্ধের অনুমতি দিতে বাধ্য থাকলেও আত্মহত্যার অনুমতি দিতে বাধ্য নই। আপনি নিরস্ত্র; সশস্ত্র যোদ্ধার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হলে আপনার মৃত্যু অনিবার্য। এমন অবস্থায় আপনাকে আমি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার অনুমতি দিতে পারি না।
–অস্ত্র আমি মুহূর্তের মধ্যে সংগ্রহ করব। নগরকোটাল! আপনি আমাকে যুদ্ধের অনুমতি দিন। এই নেকড়ের দল ক্রমশ মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।নগরীর বুকে ওদের অত্যাচার দিন দিন বর্ধিত হচ্ছে। ওদের কিঞ্চিৎ শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন।
কিঞ্জল, জল্লাদ ও নেকড়ে-বাহিনী নামে কুখ্যাত দুর্বৃত্তদের কণ্ঠে জাগল রুষ্ট হুঙ্কারধ্বনি!
–~-কী! এত স্পর্ধা!
-ওই স্থূলকায় মেদসর্বস্ব সন্ন্যাসী আমাদের শিক্ষা দেবে!
–আজ অসির সাহায্যে ওর সর্বাঙ্গে রক্তের আলপনা রচনা করব।
অকস্মাৎ দুর্বৃত্তদের আস্ফালন-ধ্বনি ডুবিয়ে জাগ্রত হল মল্লবীর জয়দ্রথের প্রচণ্ড কণ্ঠস্বর, হে সন্ন্যাসী! আপনার সহৃদয়তা ও সাহস প্রশংসার যোগ্য। আপনি অবলীলাক্রমে স্থলোদর রত্নাকর বণিককে শূন্যে উত্তোলন করে অসাধারণ শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু অস্ত্রধারী দুৰ্বত্তের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র মহাবলীও অসহায়। অতএব আপনি ক্ষান্ত হন।
-জয়দ্রথ! আমি এখনই অস্ত্র সংগ্রহ করে যুদ্ধ করব। তোমার চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই।