কিশোর শুস্বরে ধমকে উঠল, জয়দ্রথ! চুপ করো।
জল্লাদ কিঞ্জলের পাশ থেকে একটু এগিয়ে এল, তার একটি মাত্র চক্ষুর জ্বলন্ত দৃষ্টি নিবদ্ধ হল কিশোরের মুখের উপর, কর্ণদেব! তুমি নীরব কেন? আমাকে দেখে কি ভয়ে তোমার বাগরোধ হয়েছে?
কিশোর কর্ণদেব অবিচলিত স্বরে বলল, ভয় নয়, বিস্ময়। তুমি পুনর্বার আমার সামনে এসেছ দেখে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়েছি। হায় রে নির্বোধ! একটি চক্ষু বিসর্জন দিয়েও তোমার চৈতন্য হল না!
জল্লাদ ক্রুদ্ধস্বরে বলল, পামর! বৃথা গর্ব করিস না। তৃতীয় পক্ষ হস্তক্ষেপ না করলে সেইদিনই তোর প্রাণবধ করতাম। ব্যাঘ্রের আশ্রয়ে ব্যাঘ্ৰশিশুর প্রতাপ প্রকাশ পায়, একাকী ব্যাধের সম্মুখে এলে তার মৃত্যু নিশ্চিত।
কর্ণদেব হাসল, জল্লাদ! তৃতীয়পক্ষ উপস্থিত না থাকলে সেইদিনই তোমার মৃতদেহ ধরণীকে আলিঙ্গন করত… বেশ! অধিক কথায় কাজ কি? ব্যাঘ্র আজ অনুপস্থিত। এস! ব্যাঘ্ৰশিশুর দন্ত ও নখরের ধার পরীক্ষা করো। আমি তোমাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাচ্ছি।
কিঞ্জল এগিয়ে এসে জল্লাদের পাশে দাঁড়াল, তারপর মৃদুস্বরে ফিস ফিস করে বলল, জল্লাদ। আমি বুঝতে পারছি ওই কিশোরের সঙ্গে তোমার পূর্বশত্রুতা ছিল। তুমি দক্ষ অসিযোদ্ধা, কিন্তু কর্ণদেব নামে ওই কিশোর সাক্ষাৎ শমনের অগ্রদূত। আমি তোমাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে নিষেধ করছি।
জল্লাদর ওষ্ঠাধরে ফুটল কুটিল হাসির রেখা, নতকণ্ঠে সে বলল, অবশ্যই তোমার নিষেধ আমি শুনব। কিঞ্জল! আমার মন্ত্র হচ্ছে মারি অরি, পারি যে কৌশলে। আজ কর্ণদেবের রক্ষা নেই।
কর্ণদেবের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে উচ্চৈস্বরে হাঁক দিল জল্লাদ, শোনো কর্ণদেব! তোমার প্রস্তাবে আমার আপত্তি ছিল না। কিন্তু বন্ধুবর কিঞ্জল ও তার সহচর নেকড়ের দল তোমার উপর প্রতিশোধ নিতে চায়। প্রতিশোধ গ্রহণের আনন্দ থেকে আমি তাদের বঞ্চিত করতে পারি না।
তিক্তস্বরে কর্ণদেব বলল, ভীরু! কাপুরুষ! তুমি ভালোভাবেই জান দ্বন্দ্বযুদ্ধে আমার বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হলে তোমার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। তাই দলবদ্ধ হয়ে আমাকে তুমি আক্রমণ করতে চাও। এই অসম যুদ্ধে আমার মৃত্যু নিশ্চিত। তবে তুমিও জেনে রাখো- আমার অসি আজ একাধিক শত্রুর রক্তপান করবে।
কর্ণদেবের পাশে দাঁড়িয়ে লৌহখণ্ড শূন্যে আন্দোলিত করে জয়দ্রথ তীব্রস্বরে বলে উঠল, কর্ণদেব! আমার এই লৌহদণ্ড যমদণ্ডের ন্যায় শত্রুর মস্তক চুর্ণ করবে। যুদ্ধের ফলাফল অনিশ্চিত; কিন্তু সমগ্র জনমণ্ডলী আজ আমার বাহুবল দর্শন করবে। এই পৃথিবী থেকে হয়তো আমি বিদায় গ্রহণ করতে পারি তবে তার আগে কয়েকটি মূর্তিমান পাপকে এই দণ্ডের আঘাতে যমালয়ে প্রেরণ করব।
জয়দ্রথের কথা শেষ হতে না হতেই কিঞ্জলের অনুচরবর্গের কণ্ঠে জাগল ক্রুদ্ধ রণ-হুঁঙ্কার। কিঞ্জল ও জল্লাদ সম্পূর্ণ নীরব; কেবল তাদের জ্বলন্ত চক্ষের হিংস্র দৃষ্টিতে ফুটল হত্যাকারীর নিষ্ঠুর সঙ্কল্প।
আচম্বিতে অশ্বের হ্রেষাধ্বনির মতো তীব্র তীক্ষ্ণস্বরে চিৎকার করে উঠল রত্নাকর বণিক, অনর্থক বিলম্বে কি প্রয়োজন? নগর-কোটাল অনুমতি দিলেই যুদ্ধ শুরু হতে পারে।
রত্নাকর! রুষ্টস্বরে বললেন কলভবর্মা, হত্যালীলা দেখার জন্য তুমি অধীর হয়ে পড়েছ দেখছি। অনুমতি না দিয়ে অবশ্য আমার উপায় নেই। বেশ, শুরু করো যুদ্ধ।
পলাতক মৃগের পশ্চাদ্ধাবনে উন্মুখ শৃঙ্খলাবদ্ধ কুকুরের দলকে ব্যাধ যখন শৃঙ্খলমুক্ত করে দেয়, তখন তারা যেমন হিংস্র গর্জনে উল্লাস জানিয়ে ছুটে যায় নির্দিষ্ট দিকে ঠিক তেমনি ভাবেই চিৎকার করে পাঁচটি হিংস্র মানুষ নগ্ন তরবারি নিয়ে এগিয়ে গেল– তবে দ্রুতপদে নয়, ধীরে ধীরে অতি সন্তর্পণে!
পূর্ব-অভিজ্ঞতার ফলে তারা বুঝে নিয়েছে কিশোর কর্ণদেব বড় বিপজ্জনক মানুষ; আর তার পাশে লৌহদণ্ড ধারণ করে দানবের মতো যে বিপুল বপু মল্লযোদ্ধাটি অবস্থান করছে সেও অবহেলার বস্তু নয়–অতএব তারা প্রথম থেকেই সতর্ক হল।
ডানহাতে তলোয়ার আর বাঁহাতে ছুরি ধরে অনুচ্চকণ্ঠে সঙ্গীকে উদ্দেশ করে কর্ণদেব বলল, জয়দ্রথ! ওরা আসছে। বেশি কথার সময় নেই। আমার কথা শোনো–তুমি সরে যাও। অনর্থক প্রাণবিপন্ন করে লাভ কি? যদি আমি জয়লাভ করি, তবে তুমি সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পাবে। আর যদি মৃত্যু ঘটে তাহলেও তোমার বিশেষ ক্ষতি নেই। সেক্ষেত্রে তুমি স্বর্ণমুদ্রা থেকে বঞ্চিত হবে, কিন্তু প্রাণসংশয় ঘটবে না।
জয়দ্রথ গর্জন করে উঠল, কী! আবার ওই কথা! যে আমার জন্য প্রাণ দিতে বসেছে, তাকে ফেলে আমি পলায়ন করব?
নির্নিমেষ দৃষ্টি শত্রুপক্ষের গতিবিধির দিকে নিবদ্ধ রেখে কর্ণদেব বলল, জয়দ্রথ? আমি বিনাস্বার্থে প্রাণবিপন্ন করছি না। যদি যুদ্ধে জয়লাভ করে তোমার হাতে সহস্র স্বর্ণমুদ্রা তুলে দিতে পারি, তবে নিশ্চয়ই তুমি আমার প্রতি অনুরক্ত হবে। জয়দ্রথ! বহুদুর থেকে তোমার সন্ধানে আমি এসেছি, তোমার বন্ধুত্ব আমার একান্ত প্রয়োজন। ওরা আসছে; যুদ্ধে অনিচ্ছা জানিয়ে তুমি সরে যাও। যদি বেঁচে থাকি, যদি জয়লাভ করি, তাহলে আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ তুমি পাবে। কথা শোনো… আচ্ছা, যদি লজ্জা পাও তবে চুপ করে থাকো, আমি তোমার নিরপেক্ষতা ঘোষণা করছি… নগরকোটাল কলভ–