আমার আত্মমর্যাদাবোধ আছে। তোমার কোনো কথাই আমি শুনব না। হয় আমরা দুজনেই লড়ব, আর না হয়তো এ লড়াই হবে না। আমি পুরস্কারের দাবি প্রত্যাহার করব।
-আমি যোদ্ধা। একবার যখন যুদ্ধের আহ্বান জানিয়েছি, তখন আর পিছিয়ে যাব না। বেশ.. তোমার কথাই রইল। কিন্তু জয়দ্ৰথ, তোমার অস্ত্র?
–সে বিষয়ে চিন্তা করে তোমার মস্তিষ্ককে বিব্রত করো না। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।
আচম্বিতে সমবেত জনমণ্ডলীকে চমকিত করে জাগল কভবর্মার প্রচণ্ড কণ্ঠস্বর, কিশোর! দুঃসাহসেরও সীমা আছে। আমি গেরুয়াধারীর মুখে পূর্ববর্তী ঘটনার বিবরণী শুনে বুঝলাম তুমি অস্ত্রচালনায় অতিশয় নিপুণ। কিন্তু তোমার সঙ্গী অস্ত্রে অনভিজ্ঞ মল্লযোদ্ধা। অসিচালনায় দক্ষ তিন দুবৃত্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে তোমাদের মৃত্যু অনিবার্য।
নগর-কোতোয়াল। আপনার ধারণা ভুল, সামনে এগিয়ে এসে গর্বিত কণ্ঠে জয়দ্রথ বলল, আমি অসিযুদ্ধে অনভিজ্ঞ হলেও যুদ্ধে আমাকে পরাজিত করা সহজ নয়।
যে লৌহদণ্ড একটু আগে তার হাতের চাপে প্রায় গোলাকার বস্তুতে পরিণত হয়েছিল, সেই দণ্ডটি এবার সে মাটি থেকে তুলে নিল, ক্রীড়া-প্রদর্শনের সময়ে এই লৌহদণ্ড আমি বক্র করেছিলাম, এইবার এটাকে আমি অস্ত্রের উপযোগী করে নিচ্ছি। দেখুন…।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল গোলাকৃতি বস্তুটি দীর্ঘ ও সরল এক সুদৃঢ় লৌহদণ্ড হয়ে বিরাজ করছে জয়দ্রথের হাতে।
জয়দ্রথ কলভবর্মাকে উদ্দেশ করে বলল, কোতোয়াল মহাশয়! এই লৌহদণ্ডের সাহায্যে আমি অনায়াসে তিনটি তরবারির আক্রমণ প্রতিহত করতে পারব।
তিনটি নয়, চারটি! বলতে বলতে জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ করল কিঞ্জল। তার বিদীর্ণ পঞ্জর থেকে রক্ত ঝরে পরিধেয় বস্ত্র লাল হয়ে উঠেছে, কিন্তু সেদিকে তার দৃষ্টি নেই।
বিস্মিত জনতার ভিতর থেকে জাগল গুঞ্জনধ্বনি, কিঞ্জল! কিঞ্জল!
হ্যাঁ, আমি কিঞ্জল, ক্রুদ্ধস্বরে কিঞ্জল বলল, ছুরিকাঘাতের ফলে দারুণ যাতনায় কিছুক্ষণ। মূৰ্ছিত হয়ে পড়েছিলাম। এখন জ্ঞান ফিরে এসেছে এবং আমিও উঠে এসেছি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে।
কিঞ্জলের দুই চোখের জ্বলন্ত দৃষ্টি ফিরল কিশোরের দিকে, নির্বোধ বালক! তুমি সাধ করে ফাঁদে পা দিয়েছ। এখন আমি ন্যায়যুদ্ধে তোমাকে হত্যা করব। স্বয়ং নগর-কোটালও আমাকে বাধা দিতে পারবেন না।
কলবভর্মা ভগ্নস্বরে বললেন, সত্য বটে! এই যুদ্ধে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। এই রাজ্যের আইন অনুসারে কে? জল্লাদ! তুমি এখানে কি চাও?
জনতার ভিতর থেকে সকলের সামনে আত্মপ্রকাশ করল একটি ভীষণদর্শন মানুষ। তাকে দেখামাত্র দণ্ডায়মান দর্শকদের ভিতর জাগল ভয়ার্ত কণ্ঠের অস্ফুট গুঞ্জরন– অর্থাৎ, মানুষটি নগরবাসীর কাছে সুপরিচিত!
লোকটি ধীরপদে এসে দাঁড়াল কিঞ্জলের পাশে। তার কপালের উপর থেকে একটা গভীর ক্ষতচিহ্ন বামচক্ষুকে বিলুপ্ত করে গণ্ডদেশ পর্যন্ত নেমে এসেছে। ডানদিকের একটিমাত্র চক্ষু ও মুখের উপর এমন এক নিষ্ঠুর হিংসার ছায়া পরিস্ফুট যে, সেদিকে তাকালে যে-কোনো ভদ্ৰব্যক্তির বুকের ভিতর জেগে ওঠে আতঙ্কের শীতল শিহরন! লোকটির কটিবন্ধে রয়েছে দীর্ঘ তরবারি। তার চেহারা ও চালচলনে বোঝা যায় ওই তরবারি ব্যবহারের জন্য সে সর্বদাই উদগ্রীব।
পূর্বোক্ত ব্যক্তিকেই জল্লাদ নামে সম্বোধন করেছিলেন কলভবর্মা। এমন সার্থকনামা মানুষ খুব কমই দেখা যায় সন্দেহ নেই।
জল্লাদ হাসল, এই যুদ্ধে আমি কিঞ্জলের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে চাই। রাজ্যের আইন অনুসারে বিবদমান দুই পক্ষের দলভুক্ত কোনো ব্যক্তির পরিবর্তে তার স্থান গ্রহণ করে অন্য মানুষ অস্ত্রধারণ করতে পারে। আমি এখন রত্নাকর বণিকের পরিবর্তে যুদ্ধ করতে চাই। আপনি আমাকে বাধা দিতে পারেন না। তবে হ্যাঁ, রত্নাকরের যদি আপত্তি থাকে–
রত্নাকর বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্রে ঘটনার পরিণতি লক্ষ করছিল। এই মানুষটিকে সে ভালো ভাবেই জানে, কিন্তু হঠাৎ জল্লাদ কি কারণে তার উপর সদয় হয়েছে সেটা বুঝতে না পেরে রত্নাকর হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কারণ যাই হোক, জল্লাদের আচরণে যে তারই লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা সে কথা বুঝতে তার দেরি হল না– তাই জল্লাদের মুখের কথা শেষ হতে না হতেই সোসাহে এগিয়ে এসে চিৎকার করে উঠল রত্নাকর, না, না, আমার কোনো আপত্তি নেই।
জল্লাদ হেসে কলভবর্মাকে বলল, শুনলেন তো? এখন আইন অনুসারে আপনি যুদ্ধের ব্যবস্থা করুন। আমি কিঞ্জলের পক্ষে রত্নাকর বণিকের পরিবর্তে অস্ত্রধারণ করব।
হতবুদ্ধি কলভবর্মা স্খলিতস্বরে বললেন, হ্যাঁ, আইনে একটা ওই ধরনের ব্যবস্থা আছে বটে, তবে–
তবে-টবে নয়, হিংস্র হাস্যে বিকশিত হল জল্লাদের দন্তপঙক্তি, নগরকোটাল! আপনি আইনের প্রতিনিধি; আইন মানতে আপনি বাধ্য।
.
০৬. যুদ্ধ
কিশোরের দিকে ফিরে হাঁক দিল জল্লাদ, কর্ণদেব! আমাকে চিনতে পারছ?
কিশোর নিরুত্তর। হা হা শব্দে হেসে উঠল জল্লাদ।
জয়দ্রথ সবিস্ময়ে বলল, জল্লাদ তোমাকে সম্বোধন করে কথা বলছে। তোমার নাম কর্ণদেব? তোমরা পরস্পরের পরিচিত?… জল্লাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে তোমার সঙ্গে ওর শত্রুতা ছিল। আজ সুযোগ বুঝে সে তোমাকে বিপদে ফেলতে চায়। শান্তিপ্রিয় নাগরিকরা ওকে বাঘের মতো ভয় করে। জল্লাদ শুধু দুরাত্মা কিঞ্জলের বন্ধু নয়, জনশ্রুতি আছে ও নাকি দস্যু পরন্তপের