অবশেষে একসময়ে কলভবর্মার তীব্র দৃষ্টি প্রসন্নতায় সহজ হয়ে উঠল, ওষ্ঠাধারেও দেখা দিল মৃদু হাসির আভাস, তুমিই সেই কিশোর, যার কথা বলছিলেন গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী? তুমি একাকী ছুরিকামাত্র সম্বল করে অসিধারী কিঞ্জল ও তার সহচর তিন দুৰ্বত্তের সম্মুখীন হয়েছিল? বণিক রত্নাকর ও তার কুখ্যাত নেকড়ে-বাহিনীর বহু অপকীর্তির কথা আমার কানে এসেছে, কিন্তু উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ পাইনি বলেই আজ পর্যন্ত দুর্বৃত্তদের দণ্ডবিধানের ব্যবস্থা করতে পারি নি।
একবার রত্নাকর বণিক ও তার সহযোগী তিনটির দিকে তাকালেন কলবর্মা, তারপর গম্ভীরস্বরে বললেন, আজ ওদের হাতে পেয়েছি। এখনই ওদের বন্দি করব। তোমরা তিনজন কোতোয়ালিতে গিয়ে সকল ঘটনা লিপিবদ্ধ করবে। কল্যপ্রভাতেই বিচারালয়ে অপরাধীদের বিচার হবে। বিচারক নহুষ শর্মা শক্ত মানুষ। তোমাদের সাক্ষ্য শুনলে তিনি রত্নাকর ও তার দলবলকে কঠিন শাস্তি দেবেন।
কিশোরের মুখের উপর মুহূর্তের জন্য ভেসে উঠল আতঙ্কের কালোছায়া, অস্ফুটস্বরে আপনমনেই সে বলে উঠল, নহুষ শর্মা! সর্বনাশ!
তারপরই নিজেকে সামলে নিয়ে সে কলভবর্মাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, কোতোয়াল মহাশয়। কাল আমি বিচারালয়ে উপস্থিত থাকতে পারব না। বিশেষ কাজে আমাকে কাল অন্যত্র গমন করতে হবে।
নগরকোটাল কলবর্মার ভ্রু কুঞ্চিত হল, নির্বোধ! তুমি উপস্থিত না থাকলে অভিযোগ প্রমাণ করা সম্ভব নয়। তোমাকে উপস্থিত থাকতেই হবে।
–ক্ষমা করবেন। কোনোমতেই পূর্বোক্ত ব্যবস্থার অন্যথা হতে পারে না।
–আইন অনুসারে অবশ্য আমি তোমাকে জোর করতে পারি না। তুমি যদি অভিযোগ না জানাও তাহলে রাজপুরুষের কিছু করার নেই। অভিযুক্ত ব্যক্তির উপরই আমরা জোর খাটাতে পারি। তবে বুঝতে পারছি রত্নাকর আর তার নেকড়ে-বাহিনী আরও বেশ কিছুদিন নাগরিকদের উপর অত্যাচার চার্লিয়ে যাবে। এবারও রত্নাকর নিষ্কৃতি পেয়ে গেল। আর মল্লযোদ্ধা জয়দ্রথ বঞ্চিত হল প্রাপ্য পুরস্কার থেকে।
-কোতোয়াল মহাশয়। বিশ্বাস করুন আমি নিরুপায়।
শোনো ভাই, জয়দ্রথ এগিয়ে এসে কিশোরের কাঁধে হাত রাখল, তুমি সাক্ষ্য দিলে আমি সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পাব। প্রতিজ্ঞা করছি ওই অর্থের এক তৃতীয়াংশ তোমাকে দেব। তুমি প্রাণবিপন্ন করে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলে, এখন শেষরক্ষা করবে না?
আমি অর্থের প্রত্যাশী নই, কিশোর মৃদুস্বরে বলল, একটু আগেই তোমাকে ক্রীড়া-প্রদর্শনের জন্য একটি স্বর্ণমুদ্রা দিয়েছি, ভুলে যেও না।
–ভুলি নি। কিন্তু একটি বা দুটি স্বর্ণমুদ্রার প্রশ্ন তো নয়, সহস্র স্বর্ণমুদ্রা বলে কথা।
যদি আমার কথা শোনো, তবে তোমাকে আমি প্রচুর অর্থের সন্ধান দিতে পারি। সেই সম্পদের কাছে সহস্র স্বর্ণমদ্রা তুচ্ছ।
এখন আমাকে বিচারালয় থেকে তুচ্ছসহস্র স্বর্ণমুদ্রা পেতে সাহায্য করে। প্রচুর অর্থের কথা পরে চিন্তা করা যাবে।
কিশোর বিচলিত হয়ে পড়ল। যেভাবেই হোক তাকে জয়দ্রথের বিশ্বাস অর্জন করতেই হবে। কিন্তু বিচারশালায় গিয়ে তাকে সাহায্য করা সম্ভব নয়। সেখানে মূর্তিমান বিপ্নের মতো অবস্থান করছেন বিচারক নহুষ শর্মা।
কিশোর মনে মনে বলল, বিচারক নহুষ শর্মার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে আমার অস্তিত্ব তো বিপন্ন হবেই, আর সমস্ত পরিকল্পনাও হবে পণ্ড। রত্নাকরের সমবেত নেকড়ে-বাহিনীর চাইতে নহুষ শর্মার উপস্থিতি আমার পক্ষে অনেক বেশি বিপজ্জনক। কিন্তু জয়দ্রথকে হতাশ করলে সে কি আমার কোনো কথায় কর্ণপাত করবে?… তাকেও যে প্রয়োজন!… মহাসমস্যায় পড়লাম!
কলভবর্মা হাঁক দিলেন, কিশোর! মনস্থির করো। বলো, কাল তুমি বিচারালয়ে সাক্ষ্য দিতে রাজি?
বিদ্যুৎচমকের মতো একটি চিন্তা তার মস্তিষ্কে সাড়া দিল- কিশোর অনুভব করল এতক্ষণ পরে তার ডানহাতে রক্ত চলাচল শুরু হয়েছে, এখন সে অসি ধারণে সমর্থ।
জয়দ্রথের বিশ্বাস অর্জনের এই হচ্ছে সুবর্ণ সুযোগ!
অতএব–
স্মিতমুখে কিশোর বলল, কোতোয়াল মহাশয়! আমি আজ রাত্রে বিশেষ কার্যে অন্যত্র গমন করব। কিন্তু বিচারালয়ে না গিয়ে অন্য উপায়ে বর্তমান সমস্যার সমাধান বোধহয় সম্ভব। শুনেছি, এই রাজ্যের আইনে অস্ত্রের সাহায্যে বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান আছে। উভয়পক্ষের সম্মতিক্রমে রাজপ্রতিনিধির সম্মুখে সংঘটিত যুদ্ধে বিজয়ীপক্ষের দাবি মেনে নেওয়া হয়। আমি জয়দ্রথের পক্ষ থেকে বিরোধীপক্ষের সমবেত শক্তিকে একাকী যুদ্ধে আহ্বান জানাচ্ছি।
স্তম্ভিত কলবর্মা কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। রাজপথে দণ্ডায়মান নগরবাসীরাও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল– বলে কি!
কয়েক মুহূর্ত পরেই নীরবতা ভঙ্গ করে জাগল জয়দ্রথের ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর, কিশোর। তুমি কি ভেবেছ? আমার স্বার্থরক্ষার জন্য তুমি একাকী তিনটি তরবারির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লড়াই করবে আর আমি হীনবী কাপুরুষের মতো নিশ্চেষ্ট হয়ে সেই যুদ্ধ দেখব? তোমার প্রাণের মুল্যে আমি লাভ করতে চাইব স্বর্ণমুদ্রা?… না, কিশোর; আমি দরিদ্র হলেও এমন হীনচেত নই। প্রয়োজন হলে আমি স্বর্ণমুদ্রার দাবি প্রত্যাহার করব। কিন্তু অপরের জীবন বিপন্ন করে অর্থলাভ করার হীন মনোবৃত্তি আমার নেই।
জয়দ্রথ। আমি জানি তুমি হীনচেতা নও। জানি, তোমার বিশাল বক্ষের নীচে অবস্থান করছে উদার প্রশস্ত অন্তঃকরণ। তোমার প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির প্রমাণও আমি পেয়েছি। কিন্তু এ হচ্ছে অস্ত্রের মুখে প্রাণ নিয়ে খেলা। অস্ত্র নিয়ে মরণ-খেলার খেলোয়াড় তুমি নও। তাই তোমাকে আমি এই যুদ্ধে ডাকছি না। তুমি বিশ্বাস করো জয়দ্রথ–ওই তিন ব্যক্তির সম্মুখে আমি খুব অসহায় নই। মৃত্যু নিশ্চিত জানলে আমি কি ওই প্রস্তাব দিতাম? ছুরিকামাত্র সম্বল করে আমি কিঞ্জলকে কত অনায়াসে পরাস্ত করেছি সেকথা ভুলে যেও না।