মুক্ত তরবারি হস্তে এগিয়ে এল তিন দুর্বৃত্ত। কিশোর হঠাৎ বাঁদিকে ঘুরল এবং পলকে গতি সংযত করে ছুটল ডানদিকে। অকস্মাৎ গতি পরিবর্তনের ফলে মধ্যস্থলে দণ্ডায়মান দুই ব্যক্তির তলোয়ার ধাবমান শিকারকে স্পর্শ করতে পারল না। ডানদিকে যে ব্যক্তি দাঁড়িয়েছিল, সে সম্মুখবর্তী কিশোরকে লক্ষ্য করে সজোরে অসির আঘাত হানল।
কিশোর ছুরির সাহায্যে আক্রমণ প্রতিরোধের চেষ্টা করল না। অদ্ভুত কৌশলে মাটিতে বসে পড়ে সে শত্রুর আঘাত ব্যর্থ করে দিল! পরক্ষণেই এক সুদীর্ঘ লম্ফত্যাগ করে সে চলে গেল তিনটি তরবারির নাগালের বাইরে।
ক্ষিপ্রপদে তাকে লক্ষ্য করে ধেয়ে এল তিন দুর্বৃত্ত।
একটি বৃহৎ অট্টালিকার স্তম্ভে পিঠ দিয়ে উদ্যত ছুরিকা হাত অপেক্ষা করতে লাগল কিশোর।
ধীরে ধীরে এগিয়ে এল তিন দুর্বৃত্ত। কোণঠাসা শিকারের সামনে গিয়েই তাদের গতি মন্থর হয়ে পড়েছে। বেপরোয়া ভাবে আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস তাদের নেই। কিশোরের হাতের ছুরিকা যে প্রাণঘাতী আঘাতে অসিধারী প্রতিদ্বন্দ্বীকেও বিপর্যস্ত করতে পারে, সে কথা ভালো ভাবেই বুঝে নিয়েছে দ্বিপদ নেকড়ের দল–
ধীরে ধীরে অতি সন্তর্পণে তারা শিকারকে ঘিরে ফেলল, অপরাহ্নের ম্লান সূর্যালোকে জ্বলে উঠল তিনটি রক্তলোলুপ তরবারি…
আচম্বিতে দুর্বৃত্তদের কানে ভেসে এল রত্নাকর বণিকের আর্তস্বর, মাধব! কবুর! গণপতি! এই মুহূর্তে অস্ত্র সংবরণ করো। তোমরা অসি কোষবদ্ধ না করলে আমার প্রাণসংশয় অবশ্যম্ভাবী।
সচমকে ফিরে তাকাতেই তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠল এক অত্যন্ত অভাবিত দৃশ্য! স্থূলকায় রত্নাকরকে শূন্যে তুলে ধরেছে এক বিপুল বপু গেরুয়াধারী ব্যক্তি!
গেরুয়াধারী হাঁক দিয়ে বলল, ওহে নেকড়ের দল! অসি কোষবদ্ধ না করলে তোমাদের প্রভু রত্নাকরকে আমি সজোরে রাজপথে নিক্ষেপ করব। অতএব তোমরা–
গেরুয়াধারীর বাক্য সমাপ্ত না হতেই রাজপথের উপর প্রচণ্ড শব্দে জাগ্রত হল এক গম্ভীর কণ্ঠস্বর, এখানে কি হচ্ছে?
সকলে চমকে উঠল- রাজপথের উপর আবির্ভূত হয়েছে একদল সশস্ত্র অশ্বারোহী! যে ব্যক্তি তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে, প্রশ্নটা এসেছে তারই কণ্ঠ থেকে, এখানে কি হচ্ছে?
কিশোরকে যারা আক্রমণ করেছিল, তাদের মধ্যে একজন সভয়ে বলে উঠল, সর্বনাশ! নগর-কোটাল কলভবর্মা! শীঘ্র অসি কোষবদ্ধ করা।
তৎক্ষণাৎ তিনটি তরবারি সশব্দে খাপের ভিতর প্রবেশ করল। নগর-কোটাল কলভবর্মা আবার প্রশ্ন করলেন, কি ব্যাপার? এখানে কি হচ্ছে?
কোনো উত্তর না পেয়ে কলভবর্মা গেরুয়াধারীর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। গেরুয়াধারী তখন রত্নাকর বণিককে মাটিতে নামিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বণিকের একটি হাত সে চেপে ধরেছে শক্ত মুঠিতে।
কলভবর্মা কঠোর স্বরে বললেন, কেউ কথা কইবে না মনে হচ্ছে। তবে এখানে যে শান্তিভঙ্গের কারণ ঘটেছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আপনি দেখছি গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী, আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। সন্ন্যাসীর কর্তব্য সম্পর্কে আমি বিশেষ অবহিত নই বটে, তবে স্থূলোদর বণিককে শূন্যে উত্তোলন করা সন্ন্যাসীর কর্তব্যকর্মের অন্তর্গত বলে মনে হয় না। এ বিষয়ে আপনি কি বলেন?
গেরুয়াধারী বলল, আমি বলি সকল অনর্থের মূল এই রত্নাকর বণিক!
অদূরে আহত জয়দ্রথ তখন প্রহার-জর্জরিত দেহটাকে টেনে নিয়ে শায়িত অবস্থা থেকে উপবিষ্ট অবস্থায় উন্নীত করেছে। সেই দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে বলল, ওই যে ব্যাঘ্রচর্মে সজ্জিত এক ব্যক্তি ধরাশয্যা ত্যাগ করার চেষ্টা করছে, তার প্রতি একবার দৃষ্টিপাত করুন।
কলভবর্মা পূর্ববৎ কঠোর স্বরে বললেন, করেছি। কিন্তু আমার দর্শন-ইন্দ্রিয় আপনার সহায্যপ্রার্থী নয়। অনুগ্রহপূর্বক কিছু বচনসুধা পরিবেশনে আমার তৃষিত শ্রবণ-ইন্দ্রিয়কে তৃপ্ত করুন যোগিবর!
বিলক্ষণ, বিনীত হাস্যে বিগলিত হল গেরুয়াধারী, আপনার তীক্ষ্ণদৃষ্টি সম্পর্কে অধমের অজ্ঞানতা নিজগুণে মার্জনা করবেন প্রভু! আচ্ছা, এইবার সব কথা খুলে বলছি..
যা কিছু ঘটেছে তার আদ্যোপান্ত বিবরণী দিয়ে গেরুয়াধারী সহাস্যে বলল, সমস্ত ঘটনা তো শুনলেন। এখন বলুন শান্তিভঙ্গের জন্য কে দায়ী? আমি? ওই পুরস্কার লোভী মল্ল? দুঃসাহসী কিশোর? না, এই বণিক আর তার অনুগত নেকড়ের দল?
–হুম! কিন্তু সেই কিশোরটি কোথায়? আমি তাকে দেখতে চাই।
আমাকে কিছু বলছেন? কলভর্মার কথার উত্তর দিয়ে এগিয়ে এল কিশোর। এর মধ্যেই তার হাতের ছুরি খাপের ভিতর আত্মগোপন করেছে।
কলভবর্মা মাথা নেড়ে সায় দিলেন; কথা বললেন না। তাঁর দুই চক্ষের শ্যেনদৃষ্টি সম্মুখবর্তী কিশোরের সর্বাঙ্গ লেহন করতে লাগল। রাজ্যে প্রবাদ আছে, কলভবর্মা নাকি মানুষের গোপন অভিসন্ধি ইচ্ছা করলেই জানতে পারেন। প্রবাদের মুলে কতটা সত্য আছে বলা যায় না। তবে কলভবর্মার দৃষ্টিবাণ অগ্রাহ্য করে অবিচিলত ভাবে অবস্থান করতে পারে রুদ্রদমনের রাজ্যে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম।
কিন্তু কিশোরের আচরণে ভাব-বৈলক্ষণ্য প্রকাশ পেল না। সে হাসিমুখে ঈষৎ নতদৃষ্টিতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কলভবর্মার সামনে।
নগর-কোটাল নির্বাক, কিন্তু তার চক্ষু ও মস্তিষ্ক তখন তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণে সক্রিয়–
দীর্ঘাকার লঘুদেহ, কিন্তু পেশীবদ্ধ, প্রাণসার;… পায়ের আঙ্গুলে দেহভার রেখে চলাফেরা ও দাঁড়ানোর ভঙ্গি দাঙ্গা-হাঙ্গামায় অভ্যস্ত অসিযোদ্ধার মতন… মুখশ্রী সুন্দর, ললাট বুদ্ধিদীপ্ত… চক্ষে কিঞ্চিৎ উগ্রতার আভাস, তবে কৈশোরের রক্তে অগ্নির অস্তিত্ব স্বাভাবিক… ঊর্ধ্বাঙ্গের নীলাভ আঙরাখা ও নিম্নাঙ্গের ধূলিধূসরিত অথচ দৃঢ়বদ্ধ শ্বেতবস্ত্রে দারিদ্র্যের ছাপ না থাকলেও সচ্ছলতার চিহ্ন নেই… কটিদেশে এই বয়সেই অসি ও ছুরিকার অস্তিত্ব দেখে, আর যেটুকু ঘটনার বিবরণ ইতিমধ্যেই শ্রুতিগোচর হয়েছে, তা থেকে মনে হয় অস্ত্রচালনায় সুদক্ষ এই দুঃসাহসী কিশোর অসি ও ছুরিকা মাত্র সম্বল করে দুনিয়ার দরবারে নিজের ভাগ্যঅন্বেষণ করতে চলেছে..