দ্বিপদ নেকড়ের দল হর্ষধ্বনি করে উঠল। কিঞ্জলের বাম হস্তের লৌহ-আবৃত বজ্রমুষ্টি শূন্যে দুলে উঠল নিষ্ঠুর পুলকে!
কিন্তু চরম আঘাত হানার আগেই তার বাম বাহু অসহ্য যাতনায় অসাড় হয়ে গেল। আর্তনাদ করে ডান হাত দিয়ে বাম বাহু চেপে ধরে কিঞ্জল সম্মুখে দৃষ্টিপাত করল।
আঘাতের কারণ আবিষ্কার করতে বিলম্ব হল না। কিঞ্জলের সঙ্গীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে এক কিশোর তার বাঁহাতে সুদীর্ঘ ছুরিকা নৃত্য করছে জীবন্ত বিদ্যুৎশিখার মত! সঙ্গে সঙ্গে দুর্বৃত্তদের মধ্যে জেগে উঠছে আর্তনাদের পর আর্তনাদ!
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই প্রত্যেকটি দুবৃত্তের বাঁহাত ছুরিকাঘাতে বিদীর্ণ হয়ে গেল– ফলে অকর্মণ্য হয়ে গেল লৌহ-দস্তানার হিংস্র আস্ফালন!
এই বিদ্যুৎচকিত আক্রমণে স্তম্ভিত হয়ে গেল চারটি দুবৃর্ত। ডানহাত দিয়ে বাঁহাতের রক্তাক্ত ক্ষতস্থান চেপে ধরে তারা আক্রমণকারীর দিকে দৃষ্টিপাত করল।
শূন্যে রক্তাক্ত ছুরিকা আন্দোলিত করে কিশোর বলল, শোনো! সামান্য আঘাত দিয়ে আমি তোমাদের সতর্ক করে দিলাম। এখনই স্থানত্যাগ না করলে আমার ছুরিকা বাহু ছেড়ে বক্ষে বিদ্ধ। হবে।
কিঞ্জলের এক সঙ্গী তাকে মৃদুস্বরে বলল, এই কিশোরের পিছনে নিশ্চয়ই অন্য লোক আছে। একাকী আমাদের আক্রমণ করতে ও সাহস পেত না।
কিঞ্জল ক্রুদ্ধস্বরে বলল, সপশিশু এমন অতর্কিতে ছোবল মারল যে, কিছু করার সুযোগ পেলাম না। আমার বাঁহাত ছুরিকাঘাতে অবশ হয়ে গেছে।
আর এক দুর্বৃত্ত বলল, আমার অবস্থাও তোমার মতো।
চতুর্থ ব্যক্তি বলল, আমার বাঁহাতও সম্পূর্ণ অকর্মণ্য। ছুরি হাড় পর্যন্ত কেটে বসে গেছে। কিঞ্জল এখন কি করব?
কিশোরের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, যাও। শীঘ্র স্থানত্যাগ করো।
কিঞ্জলের সঙ্গীরা আদেশের অপেক্ষায় তার মুখের দিকে চাইল।
এক দুর্বৃত্ত জিজ্ঞাসা করল, কিঞ্জল আমরা কি তবে চলে যাব?
হিংস্র হাস্যে কিঞ্জলের ওষ্ঠাধর বিভক্ত হয়ে উঁকি দিল দন্তের সারি, অবশ্যই চলে যাব। কিন্তু যাওয়ার আগে বালকের কোমল মাংসে পথবাসী কুকুরের ক্ষুধা নিবারণের ব্যবস্থা করব।
পরক্ষণেই তার কটিবন্ধনের কোষ থেকে সশব্দে বিদ্যুৎবর্ষণ করে চমকে উঠল নগ্ন তরবারি।
এক সঙ্গী উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল, কিঞ্জল! তুমি কি অসি ব্যবহার করবে?
কিঞ্জল বলল, অগত্যা! আমার বামবাহু ছুরিকাঘাতে বিদীর্ণ করে এই বালক নিজের দেহের উপর তরবারির আঘাত ডেকে এনেছে। বালক সশস্ত্র; অতএব তরবারি ব্যবহার করলে শ্রাবস্তীর আইন অনুসারে আমি অপরাধী বলে গণ্য হব না। লৌহ-দস্তানার পরিবর্তে এইবার রক্তপান করবে শাণিত তরবারি।… ওহে বালক! তরবারি কোষমুক্ত করো।
কিশোর কণ্ঠে ধ্বনিত হল দর্পিত ঘোষণা, তরবারির প্রয়োজন নেই। তোমাকে শিক্ষা দেবার জন্য এই ছুরিকাই যথেষ্ট।
ভীষণ গর্জন করে তরবারি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল কিঞ্জল। তীব্র ঝনকার শব্দে অসি প্রতিহত হল। একবার নয়, পর পর দুইবার। বিদ্রুপের হাসি ফুটল কিশোরের মুখে, অত সহজ নয় হে কিঞ্জল, অত সহজ নয়।
জনতার বিস্মিত দৃষ্টির সামনে কিঞ্জলের অসি বারংবার ব্যর্থ আক্রোশে কিশোর-যোদ্ধার চতুর্দিকে ক্রুদ্ধ ভীমরুলের মতো গুঞ্জন করে ফিরতে লাগল, তীব্র ধাতব শব্দে ঝঙ্কার তুলল ছুরিকায় প্রতিহত হয়ে– কিন্তু কিশোরের অঙ্গ স্পর্শ করতে পারল না।
একজন নাগরিক উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে মন্তব্য করল, ছুরিকার সাহায্যে অসিধারীর আক্রমণ রোধ করছে ওই কিশোর! ধন্য শিক্ষা।
গেরুয়াধারী বক্তার দিকে দৃষ্টিপাত করল, দূরে দাঁড়িয়ে প্রশংসার মূল্য কি? যাও, অস্ত্রহাতে কিশোরের পাশে দাঁড়াও। শ্রাবস্তীর নাগরিকবৃন্দ যদি সশস্ত্র হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তবে নেকড়ের দল এখনই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।
আর একটি নাগরিক বলল, আমরা শান্তিপ্রিয় নাগরিক। প্রয়োজন হলে অস্ত্রধারণ করতে জানি বটে, কিন্তু আমরা ওদের মতো সংঘবদ্ধ নই। ওরা বনবাসী নেকড়ের মতো হিংস্র, নেকড়ের মতোই নিষ্ঠুর। অকারণে অথবা সামান্য কারণে ওরা নরহত্যা করতে পারে। আমরা ওদের ভয় পাই।
আচম্বিতে রাজপথের উপর জেগে উঠল তীব্র আর্তনাদ! তরবারি ফেলে দুই হাত দিয়ে রক্তাক্ত পাঁজর চেপে ধরল কিঞ্জল, তারপর পড়ে গেল মাটির উপর।
রক্তাক্ত ছুরিকা তুলে কিশোর কঠিনস্বরে বলল, তুমি মরবে না কিঞ্চল। তবে কয়েকটা দিন তোমাকে শুয়ে থাকতে হবে।
এইবার অকুস্থলে আত্মপ্রকাশ করল রত্নাকর বণিক, তীক্ষ্ণস্বরে চিৎকার করে বলল, নেকড়ের দল কি নখদন্তহীন? যাও, সবাই একসঙ্গে আক্রমণ করো।
কিঞ্জলের সঙ্গীরা হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা প্রথমে ভেবেছিল অসিধারী কিঞ্জলের হাতে অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করবে দুঃসাহসী কিশোর। ছুরিকার সাহায্যে তরবারির আক্রমণ রোধ করে কোনো ব্যক্তি যে অসিধারীকে আহত করতে পারে এমন অসম্ভব ব্যাপার তারা কল্পনাও করতে পারে নি। এখন রত্নাকর বণিকের আহ্বানে তারা সংবিৎ ফিরে পেল। খাপ থেকে তলোয়ার টেনে নিয়ে গর্জে উঠল কিঞ্জলের তিন সহচর, হারে-রে-রে!
বাঁহাতের ছুরিকাকে অগ্রবর্তী করে কিশোর প্রস্তুত হল চরম মুহূর্তের জন্য। সে বুঝেছিল আজ তার শেষ দিন। ডানহাত এখনও অবশ, ওই হাতে অসিধারণে সে অসমর্থ বাঁহাতে ছুরির সাহায্য তিন-তিনটি রক্তলোপ তরবারির আক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। অতএব, মৃত্যু আজ সুনিশ্চিত। কিন্তু বন্যমার্জার যেমন মৃত্যু অবধারিত জেনেও অসহায়ভাবে দলবদ্ধ নেকড়ের মুখে আত্মসমর্পণ করে না, হিংস্র নখরে শত্রুর দেহ ও মুখ বিদীর্ণ করতে করতে মৃত্যুবরণ করে– এই ছুরিকাধারী কিশোরও তেমনি ভাবে প্রস্তুত হল অবধারিত মৃত্যুর জন্য।