গেরুয়াধারী একবার তার দিকে দৃষ্টিপাত করে বলল, তুমি হঠাৎ জয়দ্রথের সঙ্গে কথা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছ কেন জানি না। তবে খেলাটা এখনও শেষ হয় নি।
জয়দ্রথ তখন ভূপতিত শত্রুর দিকে তাকিয়ে গর্বিত স্বরে বলছে, কিঞ্জল! আজ তোমাকে লঘুদণ্ড দিয়ে অব্যাহতি দিলাম। ভবিষ্যতে মনে রেখো মল্লযোদ্ধার গায়ে হাত দেওয়া নিরাপদ নয়।
ভূমিশয্যা থেকে কোনোরকমে হাতের উপর ভর করে শরীরটাকে একটু তুলে ধরল কিঞ্জল, বন্ধুগণ! আমরা কি এই অপমান সহ্য করব?
কখনই নয়, একাধিক কণ্ঠে জাগল হিংস্র গর্জন, ওই দুর্বিনীত মল্লকে আমরা উচিত শিক্ষা দেব। পরক্ষণেই লৌহময় বজ্রমুষ্টি তুলে তিন দুর্বৃত্ত ঝাঁপিয়ে পড়ল জয়দ্রথের উপর।
অদ্ভুত কৌশলে শত্রুর আক্রমণ এড়িয়ে প্রতি-আক্রমণ করল জয়দ্ৰথ। লৌহমুষ্টির আঘাত তার দেহের স্থানে স্থানে রক্তাক্ত ও স্ফীত ক্ষতচিহ্নের সৃষ্টি করল বটে, কিন্তু কোনো আঘাতই মারাত্মক হল না। এত দ্রুত সে দেহকে চালনা করছিল যে, শত্রুরা লক্ষ্যস্থির করে আঘাত হানার সুযোগ পাচ্ছিল না। উপরন্তু তার দুই বলিষ্ঠ বাহু দুটি লৌহদ্বারের মতোই শত্রুপক্ষের আঘাত ব্যর্থ করে দিচ্ছিল বারংবার। এরই মধ্যে হাত ও পায়ের ক্ষিপ্র সঞ্চালনে একটি শত্রুকে আহত করল জয়দ্রথ– আহত ব্যক্তি অস্ফুট আর্তনাদ করে ধরাশয্যায় লুটিয়ে পড়ল।
কিশোর উল্লসিত স্বরে বলল, বীর বটে জয়দ্রথ। একটি নিরস্ত্র মানুষের বিক্রমে পর্যদস্ত হয়ে যাচ্ছে লৌহমুষ্টি পরিহিত তিন-তিনটি দুর্বৃত্ত।
তিনটি নয় হে, গেরুয়াধারী হেসে বলল, চারটি দুর্বৃত্ত। ওই দেখ কিঞ্জল ভূমিশয্যা ত্যাগ করেছে।
কিশোর উদ্বিগ্ন নেত্রে দেখল কিঞ্জল উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে আসছে জয়দ্রথের দিকে!…
মল্লযোদ্ধার দক্ষিণ হস্তের করপুট তরবারির মতো এক প্রতিদ্বন্দীর স্কন্ধে আঘাত করে তাকে ছিটকে ফেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে মল্লযোদ্ধার মস্তকে প্রচণ্ডবেগে আঘাত হানল কিঞ্জলের লৌহদস্তানায় আবৃত বজমষ্টি— অতর্কিতে আহত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল জয়দ্রথ।
তৎক্ষণাৎ তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল চারটি দ্বিপদ নেকড়ে…
কিশোর ক্রুদ্ধস্বরে বলল, ঈস! দুরাত্মা কিঞ্জল পিছন থেকে আক্রমণ করে জয়দ্রথকে ধরাশায়ী করল। আরে! আরে! যে দুই দুর্বৃত্ত জয়দ্রথের হাতে মার খেয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছিল তারাও দেখছি উঠে পড়ল… ঈস! সবাই মিলে প্রায় অচেতন মানুষটাকে প্রহারে জর্জরিত করছে আর পথচারী নাগরিকের দল পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছে!… না! নির্বিকার চিত্তে এমন দৃশ্য দর্শন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
ক্ষিপ্রহস্তে কোষ থেকে অসি টেনে আনার জন্য অস্ত্রের হাতল চেপে ধরল কিশোর, সঙ্গে সঙ্গে লোহার সাঁড়াশির মতো কোনো বস্তু কঠিন পেষণে চেপে ধরল তার দক্ষিণ হস্তের মণিবন্ধ। সচমকে তাকিয়ে সে দেখল গেরুয়াধারীর বাঁহাতের আঙুলগুলো তার ডান হাতের কবজিতে চেপে বসেছে।
উঃ! যাতনাকাতর স্বরে বলে উঠল কিশোর, ছেড়ে দিন।
গেরুয়াধারীর হাত সরে গেল তার হাতের উপর থেকে। কিশোর বাঁহাত দিয়ে আহত ডান হাতের পরিচর্যা করতে করতে ক্রুদ্ধ নেত্রে গেরুয়াধারীর দিকে তাকাল।
গেরুয়াধারী তখন মৃদু মৃদু হাসছে।
রুষ্টস্বরে কিশোর বলল, আপনি হাসছেন? আমার হাত যন্ত্রণায় অসাড় হয়ে গেছে। আপনি আমার হাত চেপে ধরলেন কেন?
গেরুয়াধারী বলল, জয়দ্রথকে রক্ষা করার জন্য তুমি তরবারি হাতে মৃত্যর মখে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যত হয়েছিলে– তাই তোমাকে নিরস্ত করলাম।
কুঞ্চিত চক্ষে গেরুয়াধারীকে নিরীক্ষণ করতে করতে কিশোর বলল, আপনার দেহে অসুরের শক্তি। কিন্তু ওই শক্তি আমার উপর প্রয়োগ না করে বিপন্ন ব্যক্তির উদ্ধারকার্যে প্রয়োগ করলে ভালো হত। তবে আপনি আমাকে নিরস্ত করতে পারবেন না।
কথা বলতে বলতে গেরুয়াধারীর পাশ কাটিয়ে একটু এগিয়ে গেল কিশোর, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে গর্বিতস্বরে বলল, আপনার কৃপায় আমার ডানহাত অকর্মণ্য হয়ে অসিধারণে অসমর্থ, কিন্তু বাঁহাত সম্পূর্ণ সুস্থ এবং কটিদেশেও ছুরিকাও সুশানিত- আপনি আমাকে বাধা দিতে পারবেন না।
মুহূর্তের মধ্যেই কিশোরের বাঁহাতের মুঠিতে ঝকমক করে জ্বলে উঠল কোষমুক্ত সুদীর্ঘ ছুরিকা। পরক্ষণেই তীরবেগে সে ছুটল সেইদিকে, যেখানে চারটি আততায়ীর কবলে ছটফট করছে মল্লবীর জয়দ্রথ!
দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে গেরুয়াধারী আপনমনেই বলে উঠল, নাঃ! এই বালক বোধহয় আমাকে নিরপেক্ষ থাকতে দেবে না। আমি কলহ পছন্দ করি না বটে, কিন্তু চোখের সামনে নিশ্চেষ্ট হয়ে বালকের মৃত্যু দেখা সম্ভব নয়।
০৫. জল্লাদের আবির্ভাব
জয়দ্রথের সর্বাঙ্গ তখন লৌহদস্তানার মুষ্টিপ্রহারে জর্জরিত। মাটির উপর অর্ধশায়িত অবস্থায় কোনোরকমে সে মুখ আর মাথা রক্ষা করছে।
অকস্মাৎ তার কানে এল কিঞ্জলের কণ্ঠস্বর, সরে যাও। তোমাদের কর্ম নয়। এই বজ্রমুষ্টিতে আমি দুষ্ট মল্লযোদ্ধার মস্তক চূর্ণ করব।
কাঁধের সুদৃঢ় মাংসপেশীর আড়াল থেকে গ্রীবা ঘুরিয়ে জয়দ্রথ দেখল তার মুখ লক্ষ্য করে উদ্যত হয়েছে কিঞ্জলের লৌহময় মুষ্টি। পরক্ষণেই সেই মুষ্টি সবেগে নামল তার মুখ লক্ষ্য করে। হাত তুলে আত্মরক্ষার চেষ্টা করল জয়দ্রথ বাহুর মাংসপেশীর উপর পিছলে কিঞ্জলের লৌহদস্তানা শত্রুর মুখে আঘাত হানল। আঘাতের বেগ বাহুতে লেগে কিছুটা কমে গেল বটে, কিন্তু যেটুকু লাগল তাতেই চোখে অন্ধকার দেখল জয়দ্ৰথ। ক্রমাগত লৌহদস্তানার প্রহারে যে অবসন্ন হয়ে পড়েছিল, কিঞ্জলের মুষ্ট্যাঘাত এবার তার চেতনাকে প্রায় অবলুপ্ত করে দিল তার হাত সরে গেল মুখের উপর থেকে, মাথা ঝুঁকে পড়ল মাটির দিকে।