গেরুয়াধারীর সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ রেখে কিশোর একটু এগিয়ে গেল। রত্নাকর তখন ভূমিশয্যা ছেড়ে দণ্ডায়মান হয়েছে এবং অশ্বের বলগা ধরে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে জয়দ্ৰথ।
মহাশয়। জয়দ্রথ বিনীত কণ্ঠে বলল, আপনার প্রতিশ্রুত সহস্র স্বর্ণমুদ্রা কি এখানেই দেবেন? না, আপনার গৃহে যাওয়ার প্রয়োজন হবে?
দুই চোখ কপালে তুলে রত্নাকর বণিক বললে, সহস্র স্বর্ণমুদ্রা। বলে কি!
জয়দ্রথের মুখে ফুটল ক্রোধ ও বিস্ময়ের আভাস, একটু আগেই ঘোড়ার পিঠ থেকে যে পুরস্কার ঘোষণা করেছেন, এরই মধ্যে তা বিস্মৃত হয়েছেন?
রত্নাকর সপ্রতিভাবে বলল, পুরস্কারের কথা আমি বিস্মৃত হইনি। যদি তুমি আমাকে ধাবমান অশ্বের পৃষ্ঠ থেকে উদ্ধার করতে তাহলে অবশ্যই ওই পুরস্কার তোমার প্রাপ্য ছিল। কিন্তু তুমি যখন অশ্বের গতিরোধ করলে, তখন
তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে এক ব্যক্তি বলে উঠল, তখন আপনি অশ্বপৃষ্ঠ থেকে ধরাপৃষ্ঠে অবতীর্ণ হয়েছেন, অতএব
পাশের লোকটি তার মুখের কথা লুফে নিয়ে বলল, অতএব পুরস্কারের উল্লেখ করা উচিত নয়।
জয়দ্রথ তাকিয়ে দেখল ওই দুই ব্যক্তির বাঁহাত লোহার দস্তানায় ঢাকা, কটিবন্ধে তরবারি। তাদের পাশে আরও যে দুটি মানুষ নীরবে দাঁড়িয়েছিল, তাদের অস্ত্রসজ্জাও একইরকম। জয়দ্রথ বুঝল এরা একই দলের মানুষ।
রত্নাকর বণিক পূর্বোক্ত চারমূর্তির দিকে তাকিয়ে ক্রোধে ফেটে পড়ল, এই যে অকাল কুম্মাণ্ডের দল! অশ্ব যখন আমাকে বহন করে উধাও হল, তখন কি করছিলে?
প্রথমে যে ব্যক্তি কথা বলেছিল, সে উত্তর দিল, কি করব! ঘোটক যে সম্পূর্ণ বশ মানে নি সে কথা আগেই আপনাকে জানিয়ে ছিলাম। আপনি নিষেধ না শুনে অশ্বারোহণে নগর ভ্রমণ করতে গেলেন।
রত্নাকর তর্জন করে কি যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তাকে বাধা দিয়ে জয়দ্রথ বলে উঠল, মহাশয়। নিজের প্রাণ বিপন্ন করে আমি আপনার প্রাণরক্ষা করেছি। অনুগ্রহ করে প্রতিশ্রুত সহস্র স্বর্ণমুদ্রা আগে আমাকে দিন। তর্ক পরে করবেন।
রত্নাকর শুষ্ক স্বরে বলল, আমার বক্তব্য তুমি আগেই শুনেছ। আর আলোচনা অনাবশ্যক।
লৌহ-দস্তানাধারী প্রথম ব্যক্তি বলল, প্রভু! এই ব্যক্তি পলাতক অশ্বকে গ্রেপ্তার করেছে। অতএব, ওকে দুটি রজতমুদ্রা পুরস্কার না দিলে অন্যায় হবে।
ঠিক! ঠিক! রত্নাকর সোৎসাহে বলল, কিঞ্জল! তুমি সর্বদাই উচিত কথা বলো। ওকে অন্তত দুটি রজত মুদ্রা না দিলে ঘোরতর অন্যায় হবে।
কী! দুটি রজতমুদ্রা! সক্রোধে গর্জে উঠল জয়দ্ৰথ, আমি দুটি রজতমুদ্রার প্রত্যাশী নই.. বেশ! এই অশ্বকে আমি বন্দি করেছিলাম, এখন আমিই ওকে মুক্তি দিচ্ছি। ওহে কিঞ্জল! সাধ্য থাকে ঘোটকের গতি রোধ করে তুমি দুটি রজতমুদ্রা উপার্জন করো।
বলার সঙ্গে সঙ্গে অশ্বের পঞ্জরে সশব্দে এক চপেটাঘাত করে বলগা ছেড়ে দিল জয়দ্রথ।
দুরন্ত অশ্ব বিকট হেষাধ্বনি করে সম্মুখে ঝাঁপ দিল। ধাবমান অশ্বের পথ ছেড়ে সভয়ে ছিটকে সরে গেল রত্নাকর, কিঞ্জল ও তাদের তিন সহচর। রাজপথে খুরের বাজনা বাজাতে বাজাতে ঝড়ের বেগে ছুটল অশ্ব এবং দেখতে দেখতে সকলের চোখের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।
দুই হাত কোমরে রেখে অট্টহাস্য করে উঠল জয়দ্রথ। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড আঘাতে স্তব্ধ হয়ে গেল তার হাস্যধ্বনি..
পাশের সঙ্গীকে উদ্দেশ্য করে কিশোর কুদ্ধকণ্ঠে বলল, দেখুন! দেখুন! কিঞ্জল নামে নোভাকটা লোহার দস্তানা দিয়ে জয়দ্রথের মুখে আঘাত করল! কী অন্যায়।
গেরুয়াধারী নির্বিকার ভাবে বলল, নেকড়ের স্বভাবই ওই রকম। তবে এবার শক্ত পাল্লায় পড়েছে নেকড়ে। অনেকদিন পরে একটা ভালো খেলা দেখতে পাব।
আকস্মিক আঘাতে জয়দ্রথ স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। মুখের রক্ত হাত দিয়ে মুছে রক্তাক্ত হাতটাকে সে ভালো করে দেখল, তারপর বলল, কিঞ্জল! তুমি লোহার দস্তানা দিয়ে আমার মুখে মুষ্ট্যাঘাত করে রক্তপাত ঘটিয়েছ।
কিঞ্জল রূঢ়স্বরে বলল, নেকড়ের দংশনে রক্তপাত ঘটে থাকে একথা কি তুমি জানো না?
ওরে কিঞ্জল! শোনো, জয়দ্রথের রক্তাক্ত মুখে ফুটল হাসির রেখা, নেকড়ের দংশনে ব্যাঘ্রের দেহে রক্তপাত ঘটতে পারে, কিন্তু ব্যাঘ্রের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলে নেকড়ের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী।
আচম্বিতে বাঁ হাত বাড়িয়ে কিঞ্জলের ঘাড় ধরে ফেলল জয়দ্ৰথ, সঙ্গে সঙ্গে তার ডান হাতের কঠিন বাঁধনে ধরা পড়ল প্রতিদ্বন্দ্বীর কটিদেশ!
সচমকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে তলোয়ারের মুঠি চেপে ধরল কিঞ্জল, কিন্তু অস্ত্রকে কোষমুক্ত করতে পারল না। জয়দ্রথ এমনভাবে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল যে, মুষ্ট্যাঘাত করাও সম্ভব ছিল না। তাই কিঞ্জলের বামহস্তের মারাত্মক লৌহদস্তানাও হয়ে পড়ল অকর্মণ্য!
জয়দ্রথ হেসে উঠে বলল, নির্বোধ! মল্লযোদ্ধার আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলে লৌহদস্তানা অথবা তরবারি ব্যবহার করা যায় না।
পরক্ষণেই কিঞ্জলের দেহ সবেগে শূন্যপথে পাক খেয়ে মাটির উপর আছড়ে পরল সশব্দে!
কিশোর বিস্মিত স্বরে বলল, আশ্চর্য! অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী না হলে একটা বলিষ্ঠ পুরুষকে ওভাবে নিক্ষেপ করা সম্ভব নয়। জয়দ্রথ সত্যই নরব্যাঘ্র বটে। কিঞ্জলের আর উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। আশা করি এইবার জয়দ্রথের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাব।