ও ঘাড় নাড়ছে “নিশ্চয় নিশ্চয়, সত্য সত্য-”
“কি সত্য?”
“তুমি যা বলছ তা ধ্রুব সত্য, তুমি সব সময়ই নির্ভুল সত্য বল।”
“হ্যাঁ, সত্যের পরে মন, আমি করেছি সমর্পণ। তাই তো আমি সত্যকে স্বীকৃতি দিতে এসেছি। কাজটা সোজা হয় নি মির্চা, সংসার, সমাজ, আত্মীয়স্বজন, পুত্রকন্যা সকলের সামনে সম্মানের উচ্চাসন থেকে মাটিতে নেমে আসা। কেউ কেউ হয়ত ভাবছে আমার ভীমরতি হয়েছে। আরো বেশি লোক যখন জানবে কি ভাববে তারা আমাদের দেশ তো জানো? আমার গায়ে ধুলো দেবে। বেয়াল্লিশ বছর পর তোমায় দেখতে আসা কি সোজা কথা!”
“একেবারেই নয়, আমি তো কিছুতে পারতাম না। কতবার আমার স্বপ্নের ভারতে যাবার সুযোগ এসেছে আমি যাই নি কি করে যাব ওখানে?”
“কেন আমি আছি বলে?” ও মাথা নাড়ছে—“তাই তো…”
“আর আমি তো তুমি আছ বলেই এলাম। আমি এত সাহস কোথা থেকে পেলাম বলত?”
“আমিও তো তাই ভাবছি, কোথা থেকে পেলে?”
“গান্ধীজীর কাছ থেকে। আমি ভাবলাম উনি যদি পারেন আমি কেন পারব না? আর তাই যদি না পারি তবে ওঁর মৃত্যুদিনে বক্তৃতা করে কি হবে! আমি খুব বক্তৃতা করি তো।”
“গান্ধী কি এত বড় হয়েছিলেন?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, উনিশ শ’ ত্রিশে তুমি ওকে যা জানতে তার চেয়ে অনেক বড় হয়েছিলেন। উনি যে মানুষের কাজে নেমেছিলেন, শুধু তো পুঁথি পড়ছিলেন না।…তাই তো তোমায় জিজ্ঞাসা করছি, তোমার বইতে ও কি চরিত্র এঁকেছ আমার, ওখানে তো আমাকে পেলাম না আমি।”
“ফ্যাণ্টাসী, ফ্যাণ্টাসী, তোমাকে আমি রহস্যময়ী এক দেবী করতে চেয়েছিলাম যার কাজের কোনো ব্যাখ্যা নেই। অঘটনঘটনপটিয়সী কালীর মতো।”
“খবরদার আমাকে কালীর সঙ্গে তুলনা করবে না…চিরকাল তোমার এই…আমি এত কি কালো?…”
“আচ্ছা, আচ্ছা, দুর্গার মতো, যে অসম্ভব কাজ করতে পারে; inscrutable, এক হাতে অস্ত্র, অন্য হাতে বরাভয়-an enigma, the enigma that you were.”
“আমি তোমায় বলছি ফ্যাণ্টাসীর সৌন্দর্য আছে, সত্যের সৌন্দর্য উজ্জ্বলতর, কিন্তু অর্ধসত্য ভয়ঙ্কর। তোমার বইটা তাই আমার কাছে বিভীষিকা। তাছাড়া আমি খুব সহজ সরল একটা ছোট মেয়ে ছিলাম মির্চা, মাঝে মাঝে দার্শনিকের ভান করতাম এই পর্যন্ত, রহস্যটা তোমার সৃষ্টি—তুমি রহস্য ভালোবাস। কিন্তু এবার আমি অসম্ভব কাজ করতেই এসেছি–”
ও পিছন ফিরে আছে, আমি ওর দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছি—আমার অন্তর নিষ্কম্প, স্থির-ওর এই রহস্যের ঘোর আমি কাটাব—এই বাস্তব পৃথিবীর মাটিতে আমরা পরস্পরকে দেখব।
“প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো।”
মির্চা ফিরল না, ওর মাথা নিচু কিছুতেই ফিরছে না।
“কি চাও তুমি অমৃতা?”
“শান্তি, তোমার কাছে শান্তি চাই আমি।”
“হাঃ হাঃ হাঃ” ও পাগলের মত হাসছে। “তোমাকে আমি কি করে শান্তি দেব যখন আমার নিজেরই শান্তি নেই? How can I give you peace when I have no peace in me…”
কি হবে, ভয়ে আমি উতলা—ওর মাথাটাই খারাপ হয়ে গেল নাকি? এত সুন্দর এত গভীর এত পরম সত্যকে ও স্পর্শ করতে পারে না? হঠাৎ আমি বললাম—“মির্চা তুমি যে কী চমৎকার পিয়ানো বাজাতে, বাজাও তো এখনো?”
“না না, সে কবে ছেড়ে দিয়েছি।”
“কেন?”
“কী দরকার, সময় নষ্ট—“
আমি ভাবছি কি দিয়ে ও বাজাবে সঙ্গীত, ওর আঙ্গুলগুলোই যে বইয়ের মলাটের মতো শক্ত, সেখানে শিরা-উপশিরা শুকিয়ে গিয়েছে—হবে না আর হবে না, সেই মাধুরী ছাপিয়ে আকাশ আর ঝরবে না।
“মির্চা, এই যে আমি তোমার ঘরে এসে পঁড়িয়েছি রক্তমাংসের মানুষ, আমি কোনো সিম্বল নয়, মিথ নয়, আমি একজন সুখদুঃখকাতর অপার সম্ভাবনাময় মানুষ। বিয়াত্রিচে ভূত হয়ে স্বর্গে গিয়েছিল, সেখানে দান্তের সঙ্গে দেখা হল কিন্তু আমি যে এই জীবনে এলাম এটা কি কিছুই নয়!”
ও পিছন ফিরেই বলছে, একটু হাঁপাচ্ছে—“বিস্ময়! কি পরম বিস্ময়, সত্যই তো, আমি তো তাই পেসিমিস্টদের বলি, জীবনের কি অপার সম্ভাবনা কে জানে, কে জানে কি হতে পারে। কোনো দিন ভাবি নি তোমাকে দেখব?”
“তবে ফের।”
মির্চা ফিরল। কিন্তু মুখ তুলছে না, মুখ নিচু করে আছে—আমাকে দেখবার জন্য এখনও প্রস্তুত নয়। আমি মিনতি করছি, “কেন তুমি আমার দিকে দেখছ না? তুমি যে তোমার বইতে লিখেছ, যে দিন আমার সঙ্গে দেখা হবে আমার চোখের দিকে তাকাবে, সে কথা ভুলে গেলে?”
“সে তো অনেকদিন আগের কথা। চল্লিশ বছর, হায় চল্লিশ বছর।”
“জান লোকে আমায় জিজ্ঞাসা করে কতদিন তুমি আমাদের বাড়িতে ছিলে আমার মনে পড়ে না—কতদিন ছিলে বল তো?”
“হাজার বছর—”
“তবে? তবে তুমিও কি জান না তুমি কে, আমরা কি? আমি তো সেই তোমাকেই দেখতে এসেছি যাকে weapon cannot pierce, fire cannot burn-শস্ত্র ছেঁড়ে অগ্নি দহে না যারে–”।
ও সংস্কৃততে বললে, “ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে—”
“তবে? সে-ই তুমি, যার আদিও নেই অন্তও নেই–নান্তং ন মধ্যং ন পুনস্তবাদিম–সেই তোমাকেই আমি দেখতে চাইছি—আমার দিকে একবার তাকাও। বিশ্বাস করো, এক মুহূর্তে তোমায় চল্লিশ বছর পার করে দেব-দেখবে আমরা সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি যেখানে প্রথম দেখা হয়েছিল। আমার দিকে তাকালেই তুমি অমর হবে মির্চা, অমর হবে।”
মির্চা মুখ তুলল।…আমি দেখলাম ওর চোখের দৃষ্টি স্থির। কি সর্বনাশ! যা ভয় করেছিলাম তাই হয়েছে—ওর চোখ দুটো পাথর হয়ে গিয়েছে। ও আর কোনো দিনও আমায় দেখতে পাবে না। কি হবে! কি হবে! হা ঈশ্বর উপায় কি! ও চোখে আমি তো আর আলো জ্বালতে পারব না। আমার হাতে তো প্রদীপ নেই—এত পথ চলতে চলতে কখন যে তেল ফুরিয়ে সলতে পুড়ে নিবে গেছে। ভয় পেয়ে আমি আর অমৃতা নেই—একজন মরণশীল মানুষ হয়ে গেলাম। ওর মতো ভাবতে লাগলাম—হায় চল্লিশ বছর–বড় যে দেরী হয়ে গেল—একটা বুকভাঙ্গা কষ্ট দীর্ঘনিঃশ্বাস হয়ে ঘরের মধ্যে পাক দিয়ে ঘুরছে, এবার আমি পিছন ফিরলাম। ঐ দরজার কাছে পৌঁছতে হবে। ঐ পিতলের হ্যাণ্ডেলটা ঘুরাতে হবে—তারপর দরজা খুলবে। আমি ঐ একই পথে হেঁটে হেঁটে শার্লির কাছে যাব। বইয়ের পাথর ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে চলেছি হঠাৎ পিছন থেকে মির্চার গলা শুনতে পেলাম—যেন বহু দূর থেকে ভেসে আসছে–