আমার মন এখন শান্ত, স্থির, কোনো উত্তেজনা নেই, যা করবার ছিল করা হয়েছে। “এই বিরাট শহরে আজ তোমার প্রথম দিন, পথ হারাবে না তো?”
“না না, পথ হারাব না।” মনে মনে বলছি এতদূর যখন পৌঁছতে পেরেছি সময়ের মহাসিন্ধু পার হয়ে তখন মহাজগতেও আর আমি পথ হারাব না।
দরজার কাছ থেকে ফিরে মির্চার কাছে আর পৌঁছতেই পারি না, ঘরময় বই ছড়ানো, বইয়ের পর্বত চারদিকে, ঘরের ছাদ পর্যন্ত। আমার কেমন যেন গা ছমছম করছে, আমার হাত পা কাঁপছে শীত নয় ভয়ে। শুনেছি পাথর চাপা পড়ে সুকুমার জীব জীবাশ্ম হয়ে যায়, ওর তেমন কিছু হয়নি তো?…আমি ওকে দেখছি—মাথায় একেবারে চুল নেই, ঘাড়ের কাছে পাকা চুল–তেমনি পাতলা চেহারা—আর তেমনি চঞ্চল— একবার টেবিলের উপর থেকে কাগজ তুলে নিচ্ছে—আবার রেখে দিচ্ছে। ওর পাতলা শরীর যেন বাতাসে কাঁপছে।
“মির্চা তুমি মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন?”
“তোমায় আমি দেখব না, আমি অন্য লোকের জন্য অপেক্ষা করছি।”
“কার জন্য অপেক্ষা করছ, কার জন্য?”
“একজন ইনকাম ট্যাকস অফিসারের জন্য।”
“ইনকাম ট্যাকস অফিসার?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ।”
“বোকামি কোরো না মির্চা, জান আমি কে?” ওর উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলে যাচ্ছি, “চিনতে পেরেছ আমায়? জানো কে আমি, কে আমি?”
“নিশ্চয়, নিশ্চয়, (সার্টেনলি, সার্টেনলি)” ও মাথা নাড়ছে, এ যে সে-ই মির্চা একেবারেই সেই তেইশ বছরের ছেলে, ওর তেষট্টি বছরের মধ্যে সে-ই বসে আছে, আমাকে ও বলত, “তুমি ‘ভীষণ’ কথাটা খুব ব্যবহার কর—সব কিছুই তোমার ‘ভীষণ’।” ওকথা আমায় আরো অনেকে বলেছে, আমি হয়ত আজও ওরকম বলি, ও যে রকম “সার্টেনলি, সার্টেনলি” বলে মাথা নাড়ছে। কি মহারহস্য,কি অপার বিস্ময়—আমার সমস্ত সত্তা দিয়ে এই তো ওকে চিনতে পারলাম। সে এই—সে এই, অন্য কেহ নয়—আর আমি? আমি কে? আমিও সে, ‘অক্ষয় তার সপ্তদশী মন করতে পার আজো অন্বেষণ’—“বলো বলো আমি কে, বলো তবে।”
“তুমি অমৃতা। যে মুহূর্তে তুমি এদেশের মাটিতে পা দিয়েছ সেই মুহূর্তে জেনেছি আমি।…”
“কি করে জানলে?” নীরবতা।
“বল, বল, বল না।”
“হুঁ, এড্ বলেছে।”
“এড জানতই না আমি কবে আসব।”
“Well, I knew—আমি জানতে পেরেছি ব্যাস্।”
“ফের, ফের, প্রিয়তম মির্চা, আমি কতদূর থেকে এসেছি তোমাকে দেখব বলে, তুমি ফিরবে না, আমায় দেখবে না?”
“শোনো অমৃতা”, সে তার অস্থির হাতটা দিয়ে বইয়ের তাকটা ধরে আছে—যেন তা হলে পড়ে যাবে—“শোনো বলি সমস্ত ব্যাপারটাকে আমি অন্যভাবে দেখেছি–আমি তো বলছি না আমারটাই ঠিক। হয়ত তোমারটাই ঠিক, হয়ত কেন নিশ্চয়ই তোমারটাই ঠিক।”
“আমার চিঠির উত্তর দাও নি কেন? চিঠি পেয়েছিলে?”
“হ্যাঁ ছোট, দুচার লাইন।”
“তা হলই বা, উত্তর দিলে না কেন? ভদ্রতাও তো আছে।”
“ভদ্রতার কথা কে ভাবছিল?” তারপর একটু থেমে, “ঐ তো বলছি আমার সেই অতুলনীয় অভিজ্ঞতা এত সুন্দর যে আমি ভাবি নি আর তাকে স্পর্শ করা যায়—তাই তোমাকে আমি দেশকালের অতীত করে রেখে দিয়েছি।”
“আসল কথা তুমি ভেবেছিলে আমি আমার নূতন জীবনে তোমায় ভুলে গিয়েছি।”
“না না না অমৃতা, একবারের জন্য এক মুহূর্তের জন্য ভাবি নি তুমি আমায় ভুলতে পার।” ও একটা বই তাক থেকে নামিয়ে ফেলল, “শুধু আমি জানতাম না যে তুমি আমায় দেখতে চাও–”
“কেন?”
“আমরা তো জানি কত সুন্দর জিনিস আছে, সুমেরু শিখর আছে, তুষারমৌলি হিমালয় আছে, আমরা কি যেতে পারি? জানি তারা আমারই আছে তবু কি পেতে পারি? তাই বলে সেটা ভোলা নয়, সে আমার গোপন বিশ্বের গোপনতম সত্তায় লগ্ন সুন্দরতম স্বপ্ন।”
“এই তো পারলাম আমি, এই তো এলাম।”
“তুমি যে অমৃতা, indestructible অমৃতা তুমি যা পার আমি কি তা পারি? তোমার সংস্কৃতি কত হাজার বছরের পুরানো, তোমার ইতিহাস আর আমার এক তো নয়—অমর ভারতের—”
“তাই নাকি? আমি তো শুনলাম তুমিও ভারতীয়?”
“ওঃ হা, আমি তো সকলকেই বলি আমি ভারতীয়।”
“আমি এ সব কিছু শুনতে চাই না, তুমি ফের মির্চা আমি তোমায় দেখব আজ।”
ও দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু স্থির নয়—আমাদের মধ্যে অন্তত তিন গজ ব্যবধান, আমি জোরে জোরে কথা বলছি—আমাদের তো বয়স অনেক, কানের জোর নিশ্চয় কম।…ওকে উদভ্রান্ত মনে হচ্ছে।
“কি করে তোমাকে দেখব আমি? দান্তে কি কখনো ভেবেছিল তার বিয়াত্রিচেকে এই শরীরের চোখে আর দেখবে?”
আমিও কাঁপছি, ওর পাগলামি দেখে আমার রাগ হচ্ছে। এ লোকটি ঠিকই এক অবাস্তব জগৎ সৃষ্টি করে তার মধ্যে বাস করছে। কোথা থেকে দান্তে বিয়াত্রিচে নিয়ে এল—“স্থান কালের অতীত আবার কি? আমি কি ভূত হয়ে গেছি নাকি? কোন স্বপ্নজগতে কল্পনার ধোয়াটে স্বর্গে বাস কর তুমি মির্চা? আমি এই বাস্তব জগতের রক্তমাংসের অমৃতা, তোমার পড়ার ঘরে দাঁড়িয়ে আছি। এটা সত্য। এ সত্য তোমাকে স্বীকার করতে হবে। তোমার পলায়নী মনোবৃত্তি ছাড়ো তো।”
“কি করে কি করি আমি অমৃতা, তোমার যে স্বামী আছেন, আমারও স্ত্রী আছেন, এখন. কি বলি বল?”
আমি বিস্মিত, হতবাক। মির্চা বলে কি?
“–মির্চা, তুমি এত পড়লে তোমার প্রজ্ঞা হল না? প্রেম কি একটা বস্তু যে তুমি একজনের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে অন্যকে দেবে? একি বিষয় সম্পত্তি? সোনার গয়না? এ তো একটা আলো মির্চা, একটা আলো। যেমন বুদ্ধির আলো, জ্ঞানের আলো, তেমনি প্রেমের আলো। বুদ্ধির আলোরও সীমা আছে, তার একটাই ক্ষেত্র, কিন্তু প্রেমের আলো সবচেয়ে জ্যোতির্ময়, তা সব কিছুর সত্যরূপ দেখায়—এ আলো জ্বললে ত্রিভুবন প্রেমময় হবে—অপ্রিয় প্রিয় হবে—তুমি বিশ্বাস কর মির্চা তোমাকে মনে পড়বার পর আমার স্বামী আমায় কাছে প্রিয়তর হয়েছেন, এতো ভালো তাকে আগে কখনো বাসি নি। বিশ্বাস করবে তুমি?”