গাড়ি চলেছে, নূতন দেশ, নূতন শহর, অচেনা মুখ পার হয়ে হয়ে আমার চিরপরিচিত কোনো লক্ষ্যের দিকে। আমার মন আচ্ছন্ন। আমি যেন ঘুমের ঘোরে আছি। আমার এই শরীর, আমার এত দিনের জীবন, তার সঙ্গে যে-আমি এই ঠিকানা হাতে করে বসে আছি তার দূরত্ব অনেক। এই দুইকে এক করে রাখা বড় শক্ত হচ্ছে। শক্ত হচ্ছে মনে রাখা—আমি কে।
জন্ বললে, “আমরা এইবার উডল্যাণ্ডে ঢুকলাম।”
দুপাশে কি বিস্তৃত বনশ্রেণী না শহরের বাড়ি? আমি জানি না। আমি দেখতে পাচ্ছি ছোট ছোট বাগানওয়ালা বড় বড় বাড়ি—আবার কখনো দেখছি বড় বড় গাছে ছাওয়া ছায়াচ্ছন্ন পথ উডল্যাণ্ড, কোনটা সত্য? কে জানে? একটা দৃশ্য ভিতরে, একটা বাইরে। ভিতরেরটাই সত্যতর, কারণ মনই দেখে, মনই দর্শক, আমি যে জগতে এখন বাস করছি সেটা মনোজগৎ। কতদিন কত বিনিদ্র রাত্রে এই রাস্তাটার কথা ভেবেছি যেন গাছের ছায়ায় ঢাকা বাকা পথ—যদি গাছ নাও থাকে তবু সে ভাবনাটা যাবে কোথায়? আমি চোখ অর্ধেক বুজে বসে আছি—আর উডল্যাণ্ড যেন কোন মহাশূন্য থেকে ভেসে ভেসে আসছে—টুকরো টুকরো রাস্তা, ছায়াময়।
গাড়ি থামল। মলি বললে, “অমৃতা, এই মেয়ে তোমায় নিয়ে যাবে যেখানে যেতে চাও।”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “তোমরা কি অধ্যাপককে ফোন করেছিলে জানো তিনি কখন তার ঘরে থাকবেন?”
“করেছিলাম। কিন্তু তার সেক্রেটারী বললে তার সময়ের কোনো ঠিক নেই।”
শার্লি অল্প বয়সের মেয়ে—এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। আমরা একটা কাফেটেরিয়াতে খেতে বসলাম। শার্লি খাবার রাখল টেবিলে, আমি খাদ্যগুলো চিনতে পারছি না, ক্ষণে ক্ষণেই হাত থেকে কাটা পড়ে যাচ্ছে। শার্লি একটু বিস্মিত। রাস্তায় বেরিয়ে আমি বললাম— “থিয়োলজিক্যাল কলেজটা কোথায় জান?”
সে বললে, “এই তো একটা ব্লক পরে।”
“হেঁটে যেতে পারব তো?”
“সে কি, ঐ তো একটা ব্লক ওদিকে, পারবে না কেন?”
আমরা এগোচ্ছি, আমি গল্প করবার চেষ্টা করছি খুব সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে।
—“তুমি কারু সঙ্গে দেখা করবে ঐ কলেজে?”
“হ্যাঁ, আমার বন্ধু আছেন একজন।”
“তিনি জানেন তুমি আসছ?”
“না ”
“কতদিন পরে দেখা হবে?”
“মাত্র বেয়াল্লিশ বছর।”
“বেয়াল্লিশ বছর তোমাদের দেখাই হয় নি? তাহলে তো কেউ কাউকে চিনতেই পারবে না।”
“আমার তো তা মনে হয় না। বেয়াল্লিশ বছর এমন কি বেশি সময়? এই পৃথিবী কত দিনের পুরানো, সূর্যের জন্মের তারিখই বা কে জানে?” হঠাৎ আমার মনে হল এই স্বগতোক্তিগুলো জোরে জোরে করা উচিত হয় নি, ও কি ভাবল কি জানি। শার্লি কিন্তু বিস্মিত নয়, তার বিস্ময় অন্য কারণে। সে বলছে, “বেয়াল্লিশ বছর পর কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়াটা কি রকম আমি ভাবতেই পারি না।”
“পারবে, সময় হোক।”
“ড্রামাটিক।”
“সকলেই তো বলে জীবনটাই ড্রামা, দেখি কি রকম ড্রামা হয়।”
শার্লি বললে, “এই তো পৌঁছে গেছি।” হঠাৎ যেন মহাশূন্য থেকে জাদুকরের দণ্ড লেগে একটা সাইনবোর্ড বাগানের উপর জেগে উঠল। একটা সাইনবোের্ড মাত্র ঠিকানা লেখা, সেটা কি এত অর্থবহ হতে পারে। আমি কি হোলি গ্রেইল দেখেছি?
বাড়ির বড় দরজার কাছ পর্যন্ত আমি বাতাসে ভেসে চলেছি—শার্লি দরজাটা খুলল, পাশে প্রকাণ্ড বোর্ডে অনেকের নাম লেখা আছে। ও জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কার সঙ্গে দেখা করতে চাও?”
আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, কথা বলা অসম্ভব, আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলাম। “ও উনি-বিরাট মানুষ, বিখ্যাত ব্যক্তি…”
আমি এগিয়ে চলেছি, শার্লি আমার হাতের ভিতর হাত গলিয়ে ধরে নিয়ে চলেছে, কেন কে জানে? আমি কি অশীতিপর বৃদ্ধা? আমি বললাম, “ওঁর খ্যাতি কি জন্যে?”
“উনি যে মহাপণ্ডিত।”
পণ্ডিত! আমার মনটা আবার চুপসে গেল। কার সঙ্গে দেখা করতে এলাম! আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, “শার্লি, উনি পণ্ডিত না জ্ঞানী?”
শার্লি হকচকিয়ে গেছে, সে বললে, “তা জানি না, আমি সামান্য ছাত্রী, ওঁকে তো চিনি না।
আমরা লিফটের কাছে এসেছি—একজন দাঁড়িয়েছিল সে বললে, “এটা প্রাইভেট লিটবাইরে থেকে যারা আসেন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়, মাত্র তো তিনতলা।”
শার্লি খুব শক্ত গলায় বললে, “লিফটের দরজা খুলুন, ইনি কাল রাতে বহু হাজার মাইল পার হয়ে এসেছেন—এক পাও সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পারবেন না।”
আমি ভাবছি কেন একথা বলছে—আমি কি কাঁপছি? শার্লি আমাকে ধরে আছে লিফটের মধ্যেও। কি জানি কোথা থেকে এই ঘোর বিদেশে আমার একটা ছোট্ট মা এসেছে—আমাকে যেন কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে।
লিফ্ট তিনতলায় থামল। আমরা একটা লাইব্রেরীতে এসেছি। আমি যেন ঘুম থেকে চোখ মেলে দেখলাম—ওঃ একটা লাইব্রেরী, শুভারম্ভ, আমি লাইব্রেরী পার হয়ে একটা গলিতে পড়লাম—দুধারে ঘর—একটা ঘর পার হয়ে চলেছি, শার্লি একটু থেমে বললে, “ঐ তো অধ্যাপক আছেন ভিতরে।”
আমি ভিতরে ঢুকলাম।
ঢোকামাত্র, একেবারে সেই মুহূর্তে বৃদ্ধ ব্যক্তিটি একটা শব্দ করল, “ওহ্” তারপর উঠে দাঁড়াল, আবার বসে পড়ল, আবার দাঁড়িয়ে উঠল, তারপর আমার দিকে পিছন ফিরল। এ কি কাণ্ড! আমায় কি চিনতে পেরেছে? কি করে পারল? আমার দিকে তো তাকায় নি, এতদিন পরে কি পায়ের শব্দে চিনবে? অসম্ভব, যাই হোক এ তামাসাটা শার্লির সামনে হওয়া উচিত নয়। দরজার কাছে ফিরে এসে দেখি শার্লি চিত্রাপিতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার চক্ষু বিস্ফারিত। দুটি বৃদ্ধ বৃদ্ধার এই অভিনব সাক্ষাৎকারের একমাত্র দর্শক। আমি বললাম, “শার্লি তুমি চলে যাও একটু পরেই আমি তোমার কাছে আসছি।”