যাবার সময় যত এগিয়ে আসছে—আমি বুঝতে পারছি না হঠাৎ কোথা থেকে এ আবর্ত এসে এই জীবননদীর মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছে, কি এর উদ্দেশ্য, কি-ই বা পরিণাম!
আমার স্বামী আমাকে আশ্বাস দিচ্ছেন, “তুমি নিশ্চিত জেনো তোমার জীবনে এতে কোনো সুফল ফলবে। এর কোনো উদ্দেশ্য আছে, আমাদের দুজনেরই লাভ হবে।”
“তোমার আবার কি লাভ হবে!”
লাভ হবে না? লাভ তো হচ্ছে। আমি শুধু নয় আমরা সকলে তাকে আরো চিনছি, আমরা তাকে ভক্তি করছি। উনিও নিজেকে চিনছেন। কতটা ভালোবাসা, কতটা ধৈর্য, কতটা নিরভিমান হতে পারেন তার পরীক্ষা দিচ্ছেন, এবং অবলীলাক্রমে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছেন। আমি মাঝে মাঝে ভাবি আমাদের একটা সাধারণ সংসারের মধ্যে বসে আমার স্বামী যা হয়েছেন ঋষিকেশের ঐ গুহায় বসে সেই জজসাহেব মৌনী সাধু তা হতে পারলেন কিনা!
আমি স্বপ্নাচ্ছন্নের মত কাজগুলো করে যাচ্ছি। যে সমস্ত নিমন্ত্রণ পেয়েছি তার জন্য লেখা লিখছি, বৈষয়িক কাজগুলো সবই করে যাচ্ছি কিন্তু এ সমস্তে স্পৃহাশূন্য আমার মন, ভাবাবিষ্ট। এই কথাটা লেখবার জন্যই এই কলম ধরেছি, বাল্যকালে কি হয়েছিল তা লেখবার জন্য নয়। কারণ বাল্যপ্রণয় ও মধ্যপথে তার অকস্মাৎ অপঘাতমৃত্যু কোনো বিশেষ ঘটনা নয়, এরকম সর্বদাই হয়েছে, হচ্ছে, হবে। বহু লোক লিখে গিয়েছে অনেক জোরালো কলমে। আমি লিখছি বেয়াল্লিশ বছর পরে যা ঘটল সেই বিশেষ ঘটনাটার জন্য, কারণ এ এক বিস্ময়কর ঘটনা, হয়ত বা অভূতপূর্ব। মুশকিলও হয়েছে অভূতপূর্ব বলেই—এ ভাব প্রকাশের ভাষা আমার জানা নেই—যা বলতে চাইছি বলা হচ্ছে না। বাক্যগুলি যেন নিপ্রাণ ছায়ামাত্র—আমার অনুভূতিকে ধারণ করবার অযোগ্য।
মির্চার বিষয়ে নূতন করে মনে পড়বার প্রায় বছর খানেক আগে থেকেই অর্থাৎ সেরগেই আসার আগে থেকেই আমি আমার ভিতরে একটা অদ্ভুত ব্যাকুলতা অনুভব করেছিলাম সেকথা আগেই বলেছি—সেই ব্যাকুলতার তীব্রতা আমি বোঝাতে পারছি না। মনের ভিতর সেই গানটার সুর ভেসে আসত-“আমি চঞ্চল হে আমি সুদূরের পিয়াসী”—আমার এই ভাব কেবল সুরেই প্রকাশ্য। আবার চঞ্চলতা এতদূর হয়েছিল যে আমি একে ওকে তাকে বলতাম, “আমি দেশের বাইরে যাব, কোথাও যাব, একটু ব্যবস্থা করা যায় না?” আমাদের একজন সহকর্মী আছেন পাদ্রী, তাঁর অনেক জানাশোনা, তাকে ধরে পড়তাম বার বার—“আমায় একটু বাইরে কোথাও যাবার ব্যবস্থা করে দিন।”
“কোথায় যেতে চান?”
“যে কোনো জায়গায় দেশের বাইরে—”
“কেন, এদেশ দোষটা করল কি?”
আমি মুখ ভার করতাম। এ ব্যক্তি করে দেবে না।
“আচ্ছা আচ্ছা ব্যবস্থা করা যাবে, তা কোথায় যেতে চান তা তো বলবেন?”
“জাপানে, আমেরিকায়, ইংল্যাণ্ডে—যে কোন জায়গায়।”
ভদ্রলোক আমায় লক্ষ্য করছেন, “you are an amazing woman.”
এই ব্যাকুলতা যেন চন্দ্রোদয়ে চঞ্চল সমুদ্রের মতো, যেন কোন অজ্ঞাত শক্তি বহুদূর থেকে আমাকে আহ্বান করছে। আমার বন্ধন খুলে দিচ্ছে—
‘দিগন্ত হতে শুনি তব সুর, মাটি ভেদ করি ওঠে অঙ্কুর।
কারাগারে লাগে নাড়া।’
আমার কারাগার ভাঙবে, মির্চা তার নিমিত্ত মাত্র। কিসের কারাগার? এই জগক্টাকে পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে যে রকম চিনেছি, জেনেছি এবং যে জানাটাকে ধ্রুব বলে মেনেছি, সেই মূঢ় বিশ্বাসের কারাগার। আমি জানি অল্প কয়েক দিনই আমার এ ভাবটা থাকবে, চিরদিন থাকতে পারে না, কিন্তু অল্প সময়ের জন্য হলেও সেই কারাগারটা আমার পক্ষে ভাঙলো, আমি মহাকালের এক আশ্চর্য রূপ দেখতে পেলাম। আমি অন্য কোনো অবস্থানে উন্নীত হয়ে দেখলাম যাকে আমরা অতীত বলে ভাবছি, প্রকৃতপক্ষে তা অতীত নয়, তা কোথাও চলে যায় নি। তার আদিও নেই, মধ্যও নেই, অন্তও নেই। ‘নান্তং ন মধ্যং ন পুনস্তবাদিং, পশ্যামি বিশ্বেশ্বর বিশ্বরূপ এ দেখে লাভ কি হল? আমি আকূল হয়ে জিজ্ঞাসা করি যদি কোনো ঈশ্বর থাকো তো বল, লাভ কি হল আমার? কিন্তু উত্তর তো আমিই জানি, লাভ লোকসানের কথার তো খতিয়ান এখানে হবার নয়। এমন অনেক ঘটনা ঘটে যার কোন সার্থকতা নেই বাস্তব জীবনে, অথচ সেই অবান্তর অনর্থক ঘটনাগুলি দিয়েই মানুষের জগন্টা তৈরী, পশুর নয়। এই আট মাস ধরে আমি অন্তত এটুকু বুঝতে পারলাম—আমি পশু নয়, আমি মানুষ, বিশ্বরূপ দেখবার অধিকার আমার আছে।
মহাকাল আমাকে কোলে তুলে নিয়ে নৃত্য করছেন, তার জটার বাধন খুলে আমার চোখমুখ সর্বশরীর আবৃত করছে। আমার অগ্রপশ্চাত, পূর্ব পশ্চিম, দূর ও নিকটে এক হয়ে গেছে, আমার কারাগার চুরমার হয়ে গেছে, লজ্জা, ভয় আত্মীয়-স্বজনের বন্ধন সব ঝরে পড়ে গেছে। শুধু প্রেম, কালজয়ী প্রেম ঐ উজ্জ্বল নীলাকাশে ধ্রুবতারার মত আমায় পথের নির্দেশ দিচ্ছে। আমাকে মহাসমুদ্র পার করে নিয়ে যাবে।
এয়ারপোর্টে পৌঁছে আমার ইচ্ছা হল আমার স্বামীকে প্রণাম করব। তার ভালোবাসার স্নিগ্ধ বাতাস আমাকে ঘিরে আছে, আমার শরীর মন জুড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এখানে প্রণাম করা যাবে না। উনি অপ্রস্তুত হবেন। তাই আস্তে আস্তে বললাম “সারা জীবন তুমি আমায় এত স্বাধীনতা দিয়েছ।” উনি একটু একটু হাসছেন “তোমার স্বাধীনতা কি আমার পকেটে থাকে যে মাঝে মাঝে বের করে দেব? তোমার স্বাধীনতা তোমারই বস্তু।”
৪. আর বেশি দেরী নেই
মহানগরীর রাজপথে আমি সদ্য পরিচিত ‘জন্’কে বললাম, “আমরা যখন উডল্যাণ্ডের রাস্তায় যাব তখন তুমি আমায় বোলো।” ওর ঠিকানাটা আমি সংগ্রহ করেছি, অনেক কষ্টে। দেশেই সংগ্রহ করেছি ওর ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর, এত কষ্ট করে সংগ্রহ করার দরকারই ছিল না। কিন্তু দেশে ওটা জোগাড় করাই একটা অনুষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঠিক ঠিকানা চাই আমার, এতদিন তো গরঠিকানায় ঘুরলাম কত।