স্বর্গাশ্রম
৫ই ডিসেম্বর, ১৯৩০
প্রিয় খোকা,
তোমার চিঠি পড়লাম। তোমাকে ক্ষমা করবার কথাই ওঠে না। তুমি ঠিকই করেছ, তোমার বন্ধুকে তোমার বিপদের কথা লিখেছ, আমারই ত্রুটি যে তোমাকে সাহায্য করতে পারছি না।…আমি পাগলের মত কাজ করছি। উপনিষদের তত্ত্ব নিয়ে আমার প্রবন্ধ শেষ করছি। উপনিষদের কথা এইটুকু বলতে পারি যে এই বই আমার এ জীবনের সান্ত্বনা, আমার মরণেও সান্ত্বনাস্থল হবে। আমি যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ি তখনই সাহিত্য লিখি—অবসর বিনোদনের জন্যও নয় বা নাম-খ্যাতির জন্যও নয়—আমার সম্পাদকের প্রতি কর্তব্যের খাতিরে। লেখাই আমার বৈকালিক বিশ্রাম—অই আমি অনেক কাজ করছি।…এখন তোমায় একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি, তুমি কি অমৃতাকে আমার ছবিটা দেখিয়েছ? সে এখন কি করছে? তুমি প্রতি চিঠিতেই লিখছ এর সংকট এখনো কাটে নি। কিন্তু এ কথায় তো কিছু বোঝা যায় না, এ তো একটা কথা মাত্র। তুমি আশা করি বুঝছ ওর খবরের জন্য আমি কতটা উদ্বিগ্ন হয়ে আছি। আমি জানি, আমার নিশ্চিত বিশ্বাস যে ঠিক যা করা উচিত সে তাই করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে, কিন্তু আমি ওর কথা আরও জানতে চাই। তুমি কেন ওকে আমার চিঠিগুলি দেখাচ্ছ না? যখন সে একলা থাকে তখন তাকে আমার চিঠিগুলো দেখাও ও তার মনের কথা আমায় যে করেই হোক জানাও। তার মনের ঠিক কি অবস্থা আমি জানতে চাই। এ কথা লিখে লাভ নেই যে সে অতীতের কথা ভুলবে না কারণ ‘অতীত কথাটাও একটা কথা মাত্র। আমার কথা বুঝতে পারছ তো?…
আমার যে উন্মত্ত অভিজ্ঞতা হল (তুমি তাকে প্রেম বলতে পার) যা গত তিন মাস ধরে আমাকে অসীম যন্ত্রণাবিদ্ধ করেছে—এখন তার শুভ দিকটা দেখাতে শুরু করেছে। ঐ মেয়েটি আমার জীবনটাকে বদলে দিয়েছে, বদলে একে সহস্রগুণে ভালো করেছে। আমার এই জাগরণ সূর্যোদয়ের মতই মহিমাময়। আমি সত্যকে দেখেছি এবং সামাজিক জগতের ও বিদ্যার জগতের নোংরামিও দেখেছি। চতুর্দিকের ভীরুতা ও নোংরামির মধ্যে আমি নিজেকে পবিত্র মনে করছি। যত মিথ্যার বেসাতি দেখছি, আমার শান্তি হচ্ছে যে আমি দুঃখ পাচ্ছি, আমি এ জীবন উপভোগ করতে চাই না ও করব না, আমি সুখ চাই না, চাই না—ইতি তোমার বন্ধু মির্চা।
…চিঠিগুলি পড়ছি আর ভাবছি মির্চা বেনা বনে মুক্তা ছড়িয়েছে। বাবার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল আমায় লিখবে না তাই খোকাকে লিখেছে—ও নিশ্চিত ছিল খোকা আমাকে চিঠিগুলো দেখাবে এবং আমি যথাকৰ্তব্য করব। ওর বিশ্বাস ছিল আমি ঠিক সময়ে ঠিক কাজটি করব। এত বিশ্বাস ছিল আমার উপর আর আমি কি করলাম? সারা জীবন ধরে ভাবলাম যে ও আমাকে ঠকিয়েছে। করতে তো আমিই পারতাম, এ আমার দেশ, আমার কত বন্ধু ছিলেন, তারা সবাই শ্রেষ্ঠ পুরুষ। আমার কি সহায় কেউ ছিল না? তবে কেন করলাম না? কারণ আমার ধারণা ছিল এ বিষয়ে যা কিছু করণীয় পুরুষকেই করতে হবে, মেয়েরা কেন এগিয়ে যাবে, উপচিকা হবে! এও একটা কুসংস্কার এবং দম্ভ। আমি একটা বোকা অপদার্থ মেয়ে ছিলাম। অবশ্য আমি জানতাম না যে বাবা পুলিশ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে আমাকে চিঠি লেখবার চেষ্টা করলে ওকে দেশ থেকে বের করে দেবেন। তিনি ওকে লিখেছিলেন, “তুমি আমার গৃহ অপবিত্র করেছ তুমি ছিলে তৃণাচ্ছাদিত সর্প, আর সাপ যখন মাথা তোলে তখনই তাকে মারতে হয়। তাই আমি করেছি…’ কাজেই ওর কোনো উপায় ছিল না, অথচ সারা জীবন আমি ওকে সন্দেহ করে কষ্ট পেয়েছি। আর এদিকে খোকা ওকে মিথ্যা কথা বলেছে, অন্তত ছবিটার কথা যখন বলেছে যে আমায় দেখিয়েছে তখন চিঠির কথাও বলেছে, কাজেই এটা কি অসম্ভব যে ওরও মনে হয়েছে আমি ইচ্ছে করেই কিছু করলাম না, আমারও সত্য ছিল না।…আমার বাড়ির দু মাইলের মধ্যে এই চিঠিগুলো ছিল আর আমি তেতাল্লিশ বছর, পর পেলাম। এই হচ্ছে কর্মফল, ভবিতব্য। খোকা বড় বড় করে কথা বলে যাচ্ছে, “পরে পোড়ো। এখন একটু গল্প করা যাক—
আমি বললাম “উল্লুক”, রাগে কাপছি আমি। ও চমকে উঠেছে। আমার মতো পরিশীলিত মহিলার মুখে এমন একটি ইতর দুর্বাক্য উচ্চারিত হতে পারে তা ও ভাবতেই পারে নি।
“কি বলছ, কি বলছ?”
“কিছু না, একটা জন্তুর নাম।”
“কাকে বলছ?”
“ঐ জন্তুকে। খোকা এসব চিঠি আমায় কেন দেখাও নি?”
“দেখিয়েছিলাম তো।”
“দেখিয়েছিলে? মিথ্যেবাদী! কেন দেখাও নি বল।”
“দেখালে তুমি কি করতে? তোমার করার কি ছিল?”
আমি তাকিয়ে দেখছি ঐ লোকটার দিকে-মুখে ঘাম চক চক করছে—মোমবাতির আলোকে ওকে এক আদিমগুহাস্থিত জন্তুর মত মনে হচ্ছে। কেন এই লোকটা এমন শত্রুতা করল? এসব প্রশ্নের কোন উত্তর নেই এবং উত্তর পেয়েই বা কি হবে?
“চলি থোকা। এই চিঠি তিনখানা যে এতদিন রেখেছ সেজন্য ধন্যবাদ।” মনে মনে ভাবছি ওর উপর মিথ্যা রাগ করছি, এ চিঠি পড়ে কি ও বুঝতে পারে, হয়ত বা ভালো করে পড়েই নি। ব্যাগটা খুলে চিঠিগুলো ভরছি, খোকা বললে, “জানো তো কি দিনকাল পড়েছে, কত দিন রোজগার নেই, যদি পঞ্চাশটা টাকা দাও কাল র্যাশন তুলতে পারি।” আমি টাকা ক’টা ফেলে দিয়ে চলে এলাম—আমার গা ঘিনঘিন করছে। খোকা পিছন থেকে ডেকে বলছে—“ও কোথায় আছে জান?”
“নিশ্চয়ই—“
“কোথায় বলতো?”
“ঠিক যেখানে ছিল সেইখানে।”
খোকা বিস্মিত, “এ আবার একটা ঠিকানা হল?”
“আর কোনো ঠিকানা আমি জানি না ভাই।”
আমি অবাক হয়ে ভাবছি উনিশ শ ত্রিশ সাল যেন মন্ত্রণা করছিল আমাদের মিলন হতে দেবে না আর এই উনিশ শ তিয়াত্তর মন্ত্রণা করেছে আমাদের দেখা হবে। আমার আত্মবিশ্বাস বাড়ছে, আমি হয়ত গিয়ে পৌঁছতে পারব। আমি অবাক হয়ে গেছি ১৯৩০ সালে যে এরকম চিঠি লিখেছে, এত সত্যে স্থির—১৯৩৩ সালে সে ওরকম বই লিখল কি করে? আমার ভয় হচ্ছে ওর এই যে সুন্দর নরম মনটা এই চিঠির ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পাচ্ছে সেই মনট বেঁচে আছেনা পাণ্ডিত্যের চাপে শুকিয়ে গেছে। ওর পাণ্ডিত্যের খ্যাতি শুনছি আর ভয় পাচ্ছি আমি। আমি জানি বিদ্যার গুরুভারে মানুষ পিষ্ট হয়ে যায়। আমার বাবাও বলতেন, “বিদ্যা আমাদের অনেকেরই পিঠের বোঝা, ভাবাহী জন্তুর মতো আমরা চলেছি, একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই দেখেছি বিদ্যা তার রক্তে চলে গিয়ে দুদিকে পাখা গজিয়ে দিয়েছে, ঐ বিদ্যাই তাকে লঘুভার করে আকাশে ওড়াচ্ছে।”