“কখনো নয়। সে ছবি আমি দেখি নি! দেখলে ভুলতাম না।”
“ইঃ রে! একটা মানুষকে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে দিব্যি সংসারধর্ম করে, এখন আবার বলা হচ্ছে ভুলতাম না।”
“খোকা দাও, ছবিটা দাও, চিঠি কিছু না কিছু আছে, দাও তো।”
“আচ্ছা, চল্লিশ বছর আগেকার চিঠি কি আমি পকেটে করে ঘুরছি? খুঁজি, তুমি সাতদিন পরে এস।”
সাতদিন পরে গেলাম, রাগে আমার অন্তরটা জ্বলে যাচ্ছে—এত চিঠি লিখেছিল আর আমি কিছু জানি না—সে চিঠি তো আমাকেই লেখা নিশ্চয়, এই মূখ লোকটাকে এত চিঠি লিখবে কি কারণে!
বেশ কয়েকদিন ঘুরিয়ে তারপর খবর পাঠাল সে চিঠি পেয়েছে। সন্ধ্যাবেলা আবার গেলাম-খোকা উপর থেকে নেমে এল, স্থূল ললামশ শরীর, খালি গা, লুঙ্গি পরা.। লুঙ্গির পাশে চিঠি ক’টা গোজা। ওর ঐ উলঙ্গ ঘর্মসিক্ত শরীরের সঙ্গে চিঠিগুলো লেগে আছে দেখে আমার গা শির শির করতে লাগল।
হাত বাড়িয়ে দিলাম—“দাও।”
“অনেক খুঁজে এই তিনটে চিঠি পেয়েছি। আরো খুঁজবো।”
চিঠিগুলো নিয়ে মোমবাতির আলোয় পড়তে শুরু করেছি, খোকা বলছে, “বাড়ি গিয়ে পড়ো রু—একটু গল্প করা যাক, ছোটবেলার গল্প; জানো আমি তোমাদের দুজনের ছায়া কাচের কপাটে দেখেছিলাম। তারপর মির্চাকে বললাম, এস এই চেয়ারটায় বোসো, তারপর আমি গিয়ে পঁড়ালাম, দেখেছ? ঐখানে তোমাদের ছায়া দেখেছি আমি। ও তো চমকে উঠল। খোকা বকেই চলেছে, আমি চিঠি পড়তে শুরু করেছি—অপূর্ব চিঠি—একটি ইউরোপীয় মন প্রাচীন ভারতের জাদুদণ্ডের ছোঁয়ায় বিকশিত হচ্ছে আর প্রেমের দহনে দাহ্যমান, সেই সুন্দর মনের ছবি দেখতে পাচ্ছি। চিঠিগুলি জীর্ণ হয়ে এসেছে। বোঝা গেল এ চিঠির আগেও সে লিখেছে।
স্বর্গাশ্রম, ঋষিকেশ
১০ই নভেম্বর ১৯৩০
প্রিয় খোকা,
ব্ৰহ্মপুরী অরণ্যে অনেক দিন নির্জনে কাটিয়ে কাল রাত্রে আশ্রমে ফিরে তোমার চিঠি পেলাম। তোমার ও আমার মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হতেই পারে না। কিছু কিছু ঘটনা তুমি জানতে না তাই আমি খুলে লিখেছি। লোকে আমায় শ্রীচৈতন্য বলে বলুক, এই সস্তা রসিকতা আমায় স্পর্শ করে না। আমি সুখী হয়েছি যে আমার বন্ধু দু’জন তা বিশ্বাস করে না। আমার বৈরাগ্যের কথা যখন ভাববে তখন ইয়োরোপীয়দের মত ভেব না। ভারতীয় হও। তুমি আমার চেয়ে ভালো বুঝবে কেন যীশুকে মরুভূমিতে বিশ বৎসর সাধনা করতে হয়েছিল, তার বাণী পৃথিবীতে প্রচার করবার আগে। ভেবে দেখ, যিশু মাত্র আঠার মাস প্রচার করেছিলেন এবং এ পৃথিবীকে বদলে দিয়েছিলেন। আর আমি আমাদের সময়ের অনেক বুদ্ধিযুক্ত মস্তিষ্ক ও মনের কথা জানি যারা সারা জীবন প্রচার করলেও তাদের নিজের মনেরও পরিবর্তন করতে পারে না। আমি তাড়াতাড়ি সংসারে ফিরতে চাই না। রামকৃষ্ণের দরজার কাছে সারা বিশ্ব এসে গেল যখন তিনি সিদ্ধ হলেন। আর স্বামী বিবেকানন্দ সারা পৃথিবী ঘুরলেন তবু কাউকেই দীক্ষিত করতে পারলেন না। অনেক বাগবিস্তারে লাভ নেই–‘সাধনা অর্থ দেশবিদেশে বক্তৃতা দিয়ে ঘোরা আর বই লেখা নয়। অথবা এ কালের অসংখ্য গাধার কানে মন্ত্র দেওয়াও নয়। অন্তত আমার কাছে সাধনার অর্থ অন্য কিছু ও অনেক বেশি কিছু।
আমার বাবা মা ও বোন আশা করে আছেন আমি বাড়ি ফিরব তাই আমি অনেক দিন তাদের কাছ থেকে কোনো চিঠি পাই নি। কারণ আমার অল্পদিনের জন্য দেশে যাওয়া সবই ঠিক হয়েছিল। আমার বই ‘যে আলো নিবে গেছে’ ১৮ই সেপ্টেম্বর আমার বন্ধুর কাছে পৌঁছেছে, অদ্ভুত ব্যাপার না?
এই চিঠি অমৃতাকে দেখিও—ইতি মির্চা।
চিঠিটা পড়ছি আর বুঝতে পারছি বাবার উপর রাগে ওর মন জ্বলে যাচ্ছে। তার লেকচার দেওয়া দেশ বিদেশে, বিদ্যা অর্জন ও বিদ্যাদান কিছু ওর ভালো লাগছে না, কিন্তু মনে মনে তাকে অনেক বড় ভেবেছিল বলেই ঐ সব মহাপুরুষদের সঙ্গে তুলনা করেছে। বাবার এটাই দুর্ভাগ্য যে তাঁর প্রিয়জনদের কাছে তিনি দেবতা হতে চেয়েছিলেন—যদি তা না হয়ে একজন দোষগুণযুক্ত মানুষ হতেন তাঁরও দুর্ভোগ হত না—আমাদেরও না।
স্বর্গাশ্রম
২৫শে নভেম্বর ১৯৩০
প্রিয় খোকা,
আমি তোমার চিঠির অপেক্ষায় ছিলাম ও তাড়াতাড়ি পড়ছি। আমি বাড়িতে ঐ বিষয়ে কেন লিখছি না? আমার বোনকে লিখেছি খানিকটা। ওরা কেউই আমার বিষয়ে, আমার চিন্তাধারা সম্বন্ধে এত বেশি জানে না যে আমার চিঠি পেয়ে সবটা বুঝতে পারবে। ওরা জানে আমি একটি হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করব ঠিক করেছি এবং ভারতে আরও পাঁচ বছর থাকব। ওরা আমায় দোষ দেবে কারণ ওরা এইটুকুই জানে। কিন্তু আমার অন্তরের কথা আমি কাউকে বলি না…কখনই বলি না…যা হোক ওদের বলব, তবে এখনই নয়। আমি প্রত্যুষের অপেক্ষায় আছি, তোমার কি মনে হয় প্রভাত হতে অনেক দেরী হবে? দেখছ তো আমার সাহিত্যিক খ্যাতি কি কাজে লাগল? কাজেই আমি এখন সাহিত্য বা যশ ইত্যাদি গ্রাহ্যই করি না। আমি রাত্রি দিন উপনিষদ পড়ছি, আর বেদের অংশবিশেষ। আমি গুরুকুলে গিয়েছিলাম—আর্য সমাজের দ্বারা চালিত এই কলেজটি বিখ্যাত—এখানে বিভিন্ন ধর্মের তুলনামূলক বিষয়ে বক্তৃতা করতে নিমন্ত্রিত হয়েছি, আমি রাজি হয়েছি কারণ গুরুকুলে সংস্কৃতে কথা বলার সুযোগ পাব। এখানে ছাত্ররা পুরাতন ভারতের মহাভাবে উদ্বুদ্ধ—গাছের নীচে পবিত্রভাবে খোলা বাতাসে এরা বাস করে। এখন কেবল এই জীবনটাই আমি সহ্য করতে পারছি। তুমি জিজ্ঞাসা করেছ অল্পদিনের জন্যও দেশে যাচ্ছি নাকেন? কারণ তাহলে ওরা আর আমায় আসতে দেবে না! ওরা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝবে ভারত আমায় কি শিখিয়েছে। ওরা ভয় পেয়ে যাবে আর আমায় ইয়োরোপে আটকে রাখবে। ইয়োরোপ এখন আমার স্বপ্নের মহাদেশ-ওখানে আমি মুক্ত ছিলাম, আমার বয়স কম ছিল, ওখানে থাকতে জীবন সম্বন্ধে উদাসীন ছিলাম এবং শান্তিতে সুখে ছিলাম। এখন এসব আমার কাছে স্বপ্ন। সিসিলির তীর আর রোমের ধ্বংসাবশেষ, ফ্লোরেন্সের ঘন নীল আকাশ আর সুইটজারল্যাণ্ডের নির্জনতা, হয়ত এসব আমি আর কখনো দেখব না। আমাকে এখানে থেকে যুদ্ধ করতে হবে। এই ভারতে থেকে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করব আমি। ভারতই আমায় বন্ধন দিয়েছে, ভারতই মুক্তির পথ দেখাবে। আমি কাউকে ঠকাচ্ছি না, আমাকেও না, আমার দেশকেও না, কাজেই দেশে ফিরে গিয়ে আমার আধ্যাত্মিকতা সম্বন্ধে বাজে কথা বলে কিংবা আমার যোগ বিষয়ে বিদ্যা সম্বন্ধে বড়াই করে লাভ কি—যখন সত্য হচ্ছে যন্ত্রণা, শুধু যন্ত্রণা। আমি চাই তুমি আর একটু সহানুভূতির সঙ্গে বোেঝ। তুমি এখনও জান না আমার কি ভয়ানক সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে, তার গভীরতা কতদূর। আমি এখানেই থাকব। আমি পাগলের মত সংস্কৃত ও ভারতীয় দর্শন পড়ছি। একটা বাতি পেয়েছি, অনেক রাত অবধি পড়ি। এখানটা খুব ঠাণ্ডা, খুব নির্জন, কয়েকজন পণ্ডিত আছেন। অমৃতাকে আমার ওই ছবিটা দয়া করে দেখিও—সে জানে আমার কত কষ্ট যে তাকে আমার একটা ছবি পাঠাবারও অধিকার নেই। ভালোবাসা জেন—ইতি মির্চা।